Sunday, November 14, 2010

স্বনির্ভর হওয়ার গল্প

এই লিঙ্কটা (http://www.buet.ac.bd/?page_id=2506 অথবা http://www.buet.ac.bd/cse/news/news.php?newsid=51) দেখেছেন? বুয়েটের অসাধারণ প্রতিভাবান দুই ছাত্র গুগলে চাকরি পেয়েছে। তাঁদের এ সাফল্যে আমি ও আমরা সবাই মুগ্ধ। ভালো লাগে এরকম সাফল্যের কথা শুনলে। পুরো বুয়েট এ নিয়ে গর্বিত। গর্বিত হওয়ার মতোই ব্যাপার। তাঁদের একজনকে আমি চিনি, অন্যজনের কথা লোকমুখে শুনেছি। এমন প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই বিনম্র চিত্তে।

অবাক হই যখন দেখি বুয়েটের ওয়েবসাইটেও এমন সাফল্যের কথা আসে! সব সময় দেখে এসেছি পাশ করে যাওয়া শিক্ষার্থীদের তেমন কোন খোঁজই রাখে না বুয়েট, সেখানে বুয়েটের ওয়েবসাইটে এমন খবর দেখে আশান্বিত হই।

আপনাদের আরো কিছু আশার খবর শুনাই। আমার কয়েকজন ক্লাসমেট সফটওয়্যার কোম্পানি শুরু করেছিল কয়েক বছর আগে, সেখানে এখন বুয়েটসহ আরও কিছু ভাল বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করা শিক্ষার্থী চাকরি করছে। তাঁদের আর্থিক অবস্থার খবর বলতে পারবো না, তবে তাঁদের কথা আমি গর্ব করে বলি মানুষের কাছে। কয়েকজন খুব-পরিচিত জুনিয়র বাংলায় প্রযুক্তি ফোরাম খুলেছে, তাঁদের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। কয়েকজন সিনিয়র / ব্যাচমেট / জুনিয়র কে চিনি যাঁরা অন্য কোম্পানির গোলামী না করে ফ্রিল্যান্সিং করছে; স্বাধীনচেতা মানসিকতাকে সালাম জানাই। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন ব্যাচমেট মিলে কনসালটেন্সী ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে কাজ করে যাচ্ছে দেশের কিছু শিল্প-কারখানাকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করতে। আর্কিটেকচারের এক আপু আরো কিছু সমমনা মানুষকে নিয়ে নিজস্ব ফার্ম দিতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। শ্রদ্ধা জানাই স্বনির্ভর হওয়ার এমন সব প্রচেষ্টাকে। আমি নিশ্চিত, বুয়েট সম্বন্ধে যদি কিছু খোঁজ-খবর রাখেন, এরকম আর অসংখ্য ঘটনা আপনিও জানেন।

হয়তো লক্ষ্য করেছেন - আমি এমন কোন উদাহরণ দেইনি যারা বাংলাদেশের অন্যতম মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে (জিপি কিংবা ব্যাট অথবা ভাল বেতন দেয়া সফটওয়্যার কোম্পানি যাই হোক না কেন) মোটা অঙ্কের বেতনে চাকুরি করেন। বাইরের কোম্পানির জন্য কাজ করার চেয়ে, নিজের দেশে নিজে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করাকে আমি অনেক বেশি সম্মানের চোখে দেখি। দয়া করে কেউ এমন ভাববেন না যেন, আমি চাকরি করাকে অসম্মান করি; আমি বরং স্বাধীনসত্তাকে বেশি সম্মান করি।

আপনার কি মনে হয় না - এমন সাফল্যের গল্পগুলোও বুয়েটের ওয়েবসাইটে থাকা উচিত? হয়তো বলবেন - এমন ঘটনা এত বেশি যে এগুলো ডাল-ভাতের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু তারপরেও আমি বলি - নীতিগতভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত চাকুরি করার চেয়ে স্বনির্ভর হওয়াকে বেশি উসাহিত করা। বিশ্বের সবচেয়ে ভাল সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করাও শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি। তাই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে (বিশেষ করে সে বিশ্ববিদ্যালয় যখন সরকারি অর্থে পরিচালিত) স্বনির্ভর হওয়ার ডাল-ভাত গল্পগুলোই বেশি প্রত্যাশা করি, সেখানে মৌলিক গবেষণার সাফল্যগুলো বেশি প্রত্যাশা করি। নীতিগতভাবে তাই হওয়া উচিত নয় কি? তবে কি আমাদের নীতির জায়াগাটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে? আমরা হয়তো এ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত নই। L

Thursday, October 14, 2010

এলোমেলো - ০৬

মনের এত শত্রু কেন ??

Tuesday, September 14, 2010

এলোমেলো - ০৫

কত বার তার মুন্ডু ছিড়েছো
মনে আছে তোমার?
কত বার তাকে কবর দিয়েছো
হিসেব আছে তোমার?

Friday, August 13, 2010

লোডশেডিং

লোডশেডিং নিয়ে ভিন্ন সময়ের দুই বাংলাদেশীর মধ্যে কথা হচ্ছে  -


অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ের বাংলাদেশীঃ
ধূর, কী যে দিনকাল পড়ছে, ইলেক্ট্রিসিটি এই আসে তো এই যায়! কখন থাকে আর কখন থাকে না কিছুই বলা যায় না। :-(


স্বপ্নের সময়ের বাংলাদেশীঃ
হায় হায়! অবস্থা এত খারাপ? :-O আমাদেরতো এরকম হয় না, সব কিছুই চলে পরিকল্পনামাফিক।

আমরা এখন স্বপ্নের সময়ে বাস করছি। কারণ, আমরা জানি, দিন-রাত যেকোন সময় ইলেক্ট্রিসিটি প্রতি ১ ঘন্টা পর-পর যাবে-আসবে!!!

Wednesday, March 24, 2010

পিপাসা

গল্প করবে আমার সাথে একটু খানি?
টক ঝাল কিংবা মিষ্টি
ভাল হয় যদি মিশিয়ে দাও দু' চামচ পাগলামি।

Monday, March 22, 2010

গুলশান এক্সপ্রেস

বস্তার মধ্যে ধান ভরেছেন কখনো? কিংবা অন্য যেকোন প্রকারের মালামাল? তাহলে বস্তার উপরের দুই প্রান্ত ধরে ঝাঁকানাকা দেবার কথা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। পুরো ঠেসে মালামাল ভরার পরেও, একটুখানি ঝাঁকানাকার ফলে কোথা থেকে যে আরো জায়গা বের হয় - এমনটি ভেবে অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই কোন-না-কোন দিন। অবশ্য যদি কোনদিন আসলেই কাজটি আপনি করে থাকেন। এই ঝাঁকানাকার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সম্মান রেখেই বলছি- আমি এখন যে বাসখানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, সেটিকে যতই ঝাঁকানো হোক না কেন, আর একজন লোকও অতিরিক্ত নেয়া যাবে না তাতে।

৬ নম্বর বাসের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। দাঁড়িয়ে আছি না বলে যদি বলি "আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে" ভুল হবে না মোটেও। এদিক-ওদিক থেকে কত জন মিলে যে আমার শরীরটাকে ধাক্কা মেরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে- আমি ঠিক নিশ্চিত নই। এক হাতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি ওজনের ব্যাগ, যেটি পায়ের কাছাকাছি কোথাও আছে। আমার চক্ষুদ্বয়ের সাহস নেই যে ঘাড়কে বলে - "মাথাটা একটু নোয়াও তো, ব্যাগটা একটু দেখি"। অন্য হাতখানি আরেকজনের ঘাড়ের উপর দিয়ে কোন এক রড ধরে আছে। যদিও হাতখানির যুৎ হচ্ছে না তেমন, তবুও নড়তে পারছে না হাত দুটো, পাছে পাশের জনের নাকখানি ভেঙ্গে যায়।

পদার্থবিদদের এই মুহুর্তে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে- "আমার আর পাশের লোক শরীরের মধ্যে দূরত্ব কত?" কেউ যদি ফড়ফড় করে উত্তর দেয় 'শুন্য', তবে তাকে 'অপদার্থ' বলে গালি দেয়ার ইচ্ছেটাও ষোল আনা। আরে বাবা, ঐ লোকের চাপে আমি যে চ্যাপ্টা হয়ে গেলাম, আমার শরীর যে সংকুচিত হয়ে গেল, সেই হিসাব যাবে কোথায়? দেখে যাও পদার্থবিদগণ- দূরত্ব এখানে ঋণাত্মক!

আচ্ছা, আমি যদি এই মুহুর্তে আপনার  কাছে একটু সাহায্য চাই, করবেন? বেশি কিছু না, সামান্য, খুব সামান্য। অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে ভাল লাগে না, কিন্তু কী করি বলেন, আমার যে খুব দরকার। কীভাবে যে বলি... যাই হোক, বলেই ফেলি- "আমার চুলগুলো কপালের উপর এসে পড়েছে, অস্বস্তি লাগছে, সরিয়ে দিবেন? নাকটাও খুব চুলকাচ্ছে, একটু চুলকিয়ে দিবেন?"

Friday, March 19, 2010

জীবনচক্র


ব্যাঙের কথা মনে পড়ে? ব্যাঙের জীবনচক্রের কথা? ডিম-ব্যাঙাচি-লেজ-সাঁতার? মনে পড়ে কিছু? আবছা আবছা মনে পড়ে আমার। বিশেষ করে তীর চিহ্নের গোল গোল ছবির কথা। ঐ ছবিটা কিন্তু আমি বেশ ভালই আঁকতে পারতাম। বর্ণণা তো পারতাম তা তেমন, তাই পরীক্ষার খাতায় ছবিটাই ছিল ভরসা। স্যার/ম্যাডাম রা ছবি দেখেই [আর খাতায় আমার নাম দেখে ;)] নম্বর দিয়ে দিতেন। আমি নিজেও মুগ্ধ হয়ে যেতাম অন্যদের সাথে আমার আঁকা ছবি তুলনা করে।

খেয়াল করে দেখি আজও আমি সেই জীবনচক্রের ছবি ভালই এঁকে চলেছি। পেন্সিলের শিসে নয়, বাস্তবে। অফিস-বাসা-ঘুম-অফিস। এই করে চলছে...

Thursday, March 18, 2010

বজ্রপাত

১.
দাড়িয়াবান্ধার শেষ ঘরটা যখন পার হই-পার হই করছে আপন, ঠিক তখনি মায়ের উচ্চস্বরে ডাক- "আ-প--ন, দেইখ্‌খা যা কেডা আইছে..."।

ইসসস, এই সময় কেউ ডাকে! কিন্তু মায়ের কন্ঠে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু। দেরি করা যাবে না। আর এটাতো শেষ ঘর, এখানে আপনকে আটকাতে পারবে না কেউ। এক দিকে দ্রুত যাবার ভান করে, তারও চেয়ে দ্রুত গতিতে দিক পরিবর্তন করে দৌড়ে অন্য দিকের কোণা কেটে বেরিয়ে যায় আপন। দাড়িয়াবান্ধার দৌড় থামায় না সে। বাড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে বলে- "আমি গেলাম"।

এদিকে অপর পক্ষের অঞ্জন চিল্লাতে থাকে- "হয় নাই, হয় নাই, কোণা কাটা হয় নাই। পচ্চা। পচ্চা।" কিন্তু কে শুনে কার কথা! আপন ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে। মায়ের কন্ঠে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু।

ঘরে ঢুকেই অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠে আপন- "ইয়েয়েয়ে দহহহহন!"  তারপর হঠাৎই থেমে যায়। ঢাকার কাকা-কাকিরা অন্যদের চাইতে কেমন যেন ঠান্ডা-ঠান্ডা স্বভাবের। তারা হয়তো তার এই অকারণ চিৎকার পছন্দ করবে না। তবে চিৎকার থামালেও দহনের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে থামায় না- "আয়, খেলি গিয়া।" বেচারা দহন অল্পক্ষণের জন্য আমার-কোন-দোষ-নাই ভঙ্গিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রতিরোধের ক্ষীণ-থেকে-ক্ষীণতর চেষ্টা করে। এরপরই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দুজনে ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে মাঠে, যেখানে এখনো দাড়িয়াবান্ধা খেলা চলছে।

দহন আর আপন কাকাত-জেঠাত ভাই। দুজনেরই বয়স সমানে সমান- পিঠেপিঠি। দহন ১৭ দিনের ছোট। দহন ঢাকায় থাকে, আপন গ্রামের বাড়িতে। দুজনে খুব একটা দেখা হয় না, বছরে একবার কি সর্বোচ্চ দুবার। এবার দাদুর মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেছে তারা। দুদিন থাকবে।

দহনের ফিটফাট-বাবু-টাইপ চেহারা দেখে মাঠের সবাই ফিরে ফিরে তাকায় তার দিকে। আপন তাদের দিকে তাকায় 'আমার-ভাই' মার্কা ভাব নিয়ে। এরপর দহনকে জিজ্ঞেস করে-"খেলবি?"
দহন বলে- "কি?"
- "দাইড়া। পারস?"
দহন দুদিকে মাথা নাড়ে- "কিভাবে খেলে?"
- "আরে, এতো দুনিয়ার সোজা খেলা। এই যে লম্বা চিকন ঘরগুলা দেখতাছস, এইগুলাতে বিপক্ষ দলের মাইনসেরা খাড়াইয়া থাকব। আমরা, মানে আমগো দলের মাইনসেগো তাগোরে ফাঁকি দিয়া এই ঘরগুলা পার হইতে হইবো, এমুনভাবে পার হইতে হইবো বিপক্ষ দলের মাইনসে জানি ধরতে না পারে। ঘরগুলা একবার পার হইয়া ঐ পার যাইতে হইবো, আবার এইপার আইতে হইবো। তাইলে জিতা যামু।"
- "পারব না।" ইতস্তত করে দহন।
- "আরে পারবি।" অভয় দেয় আপন।

অন্যদের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক দেয় আপন- "অই, আমরা দুইজন খেলমু। আমগোরে এক দলে লওন লাগবো।"

সে খেলা শেষ হয়নি। তার আগেই বৃষ্টি এসে পড়ে। আর কোথা থেকে যেন ফুটবল এসে হাজির। দহন চলে আসতে চাইছিল, কিন্তু আপন আসতে দেয়নি। বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে তারা। কারো কোন দল নেই। যে যেদিক পারে বল নিয়ে যায়। তবে কেউই বেশি দূর নিতে পারে না। একটু পরই ধপাস! পিছলে পড়ে যায় পানিতে। কেউ কেউ দূর থেকে এসে ঘাসে স্লাইড করে বলের উপর পিছলে পড়ে। শুরুতে স্লাইড করেনি দহন, পরে এতই মজা পেয়ে যায় যে সে শুধুই স্লাইড করতে থাকে। দহনের ফিটফাট-বাবু-টাইপ চেহারায় যোগ হয় উচ্ছলতা।


২.
আজকের সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে দহনের মনে পড়ে সেই বৃষ্টির দিনের কথা। ফুটবল খেলা শেষে মায়ের অগ্নিচক্ষু এখনো চোখে ভাসে। অথচ কী দূরন্তই না ছিল আপনটা। বাড়ি এসে স্নান শেষে দহন যখন চুপচাপ বাবুর মত বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে ছিল, আপন তখন চুপিচুপি এসে ইশারায় ডাকে- "চল, চানাচুর খাইয়া আসি।" চানাচুর নয়, আপনের ডাকে কী যেন এক মাদকতা ছিল, সেই মাদকতার টানেই দহন গুটি গুটি পায়ে আপনের পিছু নেয়। আলো-আঁধারির সন্ধ্যায় তারা চলে যায় বাংলা ঘরের পিছনে। সেখান থেকে এক টুকরা টিন আর আরেকটা ভাঙ্গা কাচের বোতল কুড়িয়ে নেয় আপন। এরপর পিছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুজনে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। খানিকটা দূরে এক লোক কাঁধে বাঁশ রেখে, বাঁশের এক দিকে চানাচুর আর বাদামের বাক্স, অন্যদিকে পাটের বস্তা ঝুলিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আপন দৌড়ে ধরে তাকে। দহন চলে পিছু পিছু। টিন আর কাচের বোতলের বদলে চানাচুর কিনে তারা। বেশ আয়েশ করে চানাচুর খেতে থাকে তারা। একটা একটা করে চানাচুর। উফফ, কী ঝালই না ছিল!

চানাচুর খাওয়া শেষে যখন তারা বাড়ি ফিরছিল- তখনি দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল আবার। দুজনে ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে বাংলা ঘরের বারান্দায়। হব-হব সন্ধ্যা যেন হঠাৎ করেই রাত হয়ে গেল। কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে যাচ্ছিল দহন। আলো দেখলেই তাই দু'হাতে কান চেপে ধরছিল। এ দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল আপন। আলো দেখলেই তাই বলে উঠছিল- "কানে ধর, কানে ধর, উঠ-বস কর"। আর দহন কানে ধরলেই হো হো করে হেসে উঠছিল আপন।

আজ আবার বজ্রের শব্দ শুনতে ইচ্ছে করছে দহনের। বজ্রপাতের আলো দেখলেই দু'হাতে কান চেপে ধরছে। কিন্তু হায়, বজ্রপাতের শব্দ কোথায়? এতো কেবলই গাড়ির হর্ণের আওয়াজ! হর্ণের অত্যাচার সহ্য হয়ে গেছে, বজ্রপাত আর তাই ভয় জাগায় না। তবে কি হর্ণের আওয়াজ বজ্রপাতের চেয়েও তীব্র???

Tuesday, March 2, 2010

তাক্‌ ধি না ধিন্‌

রঙ-এর আজকের ছুটিটা অন্যরকম।

সেবার ক্লাস নাইনে রঙ স্কুলে যায়নি একদিন। জ্বর এসেছিল কি আসেনি মনে পড়ে না তার। সম্ভবতঃ এসেছিল, না হলে স্কুল ফাঁকি দেয়ার ছেলে সে নয়। তবে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে যে একদমই ছিল না, একেবারে নিঃসন্দেহ। মুরুব্বিদের ভাষ্যমতে পাড়ার ঐ অভদ্র আর বখাটে ছেলেগুলোর সাথে মার্বেল খেলে সেদিনের সকালটা কাটিয়েছিল সে। দুপুরটা পার করেছে ঘুমিয়ে। আর বিকেলে গিয়েছিল পাশের গ্রাম গনেরগাঁয়, ক্রিকেট খেলতে। দু' ম্যাচ করে খেলা হত প্রতিদিন। ১ম ম্যাচের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না যে রঙকে পাবে। ভাগ্যদেবী সেদিন ১ম ম্যাচের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। আনন্দে আনন্দে কাটিয়েছিল দিনটা।

পরদিন ১ম ক্লাসেই কিরণ স্যারের মুখদর্শন। কিরণ স্যারকে চেনে না এমন ছাত্র কিংবা ছাত্রী স্কুলে থাকতে পারে, তবে তাকে ভয় পায়না এমন কেউ বোধ করি ছিল না। যেমন ভাল তিনি পড়াতেন, তেমনি ভাল তিনি পিটাতেন। সবসময় যে তিনি পিটাতেন তা কিন্তু না, বড় জোর ২/৩ মাসে একদিন। কোনদিন তাকে বেত নিয়ে ক্লাসে আসতে দেখলেই সবার মধ্যে হিড়িক পড়ে যেত সেদিনের পড়া শিখার। সেদিনও তাকে আসতে দেখা গিয়েছিল বেত হাতে। যেসব ভাগ্যবান ছাত্র আগেই স্যারকে দেখেছে তারা আস্তে করে পিছনের দরজা দিয়ে চম্পট। ক্লাসে এসে রোল কল করার পরই স্যারকে সেই রূপে দেখা গেল, হাঁটুদ্বয়ের উপর দু' হাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার হতে উঠে দাঁড়ালেন- "গতকাল কে কে স্কুলে আসনি, দাঁড়াও।" দাঁড়াতে দাঁড়াতে রঙ ভাবছিল- তবে কি তাকে শায়েস্তা করতেই আজকের আয়োজন? এর আগে কোনদিন স্যারের কাছে ধরা খায়নি রঙ। ভাল ছাত্র বলে প্রায় সব শিক্ষকের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত সুবিধা পায় সে, আজ কি তার দেখা মিলবে না? প্রস্তুত রঙ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। স্যারও শুরু করলেন ১ম বেঞ্চের কোনা থেকে, রঙকে দিয়েই। চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করলেন- "গতকাল স্কুলে আসনি কেন?" মুখে কিছু বলে না রঙ, দ্রুত হৃদস্পন্দন কথা বলতে দেয় না তাকে।  খাতার মধ্য থেকে একখানা দরখাস্ত বের করে স্যারের হাতে দেয়, রঙের বাবার স্বাক্ষর আছে সেখানে। দরখাস্তটা বেঞ্চের উপর রাখেন স্যার। হৃদকম্পন বাড়ে রঙের, ঠোঁট কামড়ে ধরে চেয়ে থাকে স্যারের দিকে। স্যারের চোখের মনি এপাশ-ওপাশ করছে। দরখাস্ত পড়ার সময় বেশ শান্ত দেখায় স্যারকে, কিন্তু ঠিক ভরসা পায়না রঙ। কারণ সে জানে, যেদিন স্যার বেত মারেন, সেদিন ভয়ানক ঠান্ডা থাকে তার প্রকৃতি। একটু পর স্যার চলে এলেন তার নিজের চেয়ারের সামনে, হাতের ইশারায় বসতে বললেন সবাইকে। বেঁচে গেল সবাই। রঙ বুঝতে পারল- সেই ছিল আজকের লক্ষ্য। এ কারণেই কিরণ স্যারকে এত শ্রদ্ধা তার- ভাল ছাত্র বলে অযাচিত সুবিধা তিনি কাউকে দেন না। তবে দরখাস্তের উপযোগিতায় যারপর নাই মুগ্ধ হল রঙ।

তবে আজকের ছুটিটা অন্যরকম, এমনকি বৃষ্টির ছুটির মতোও নয়।

বৃষ্টির দিনে, সকালে তুমোল বৃষ্টি হত এমন দিনে, যেদিন কেউই তেমন স্কুলে যেত না, যেতে পারত না, সেদিন অতি অবশ্যই স্কুলে যেত রঙ। গিয়েই একখানা দরখাস্ত লিখত, দরখাস্ত লেখাকে বাস্তব কাজে লাগানোর দিকে বরাবরই বিশেষ আগ্রহ তার। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে অনেকে স্কুলে আসতে পারে নি, যারা এসেছে তাদের কাপড়-চোপড়ও ভিজা, তাই ছুটি চাই ১ম ঘন্টা শেষে। এরপর আরো দুয়েকজনকে নিয়ে ঘুরত ক্লাসে ক্লাসে ক্লাস-ক্যাপ্টেনের স্বাক্ষর নিতে, মেয়েদের ক্লাসগুলোতেও ঢু মারা যেত এই সুযোগে। শিক্ষকরাও খুব করে চাইতেন এমন ছুটি, তাই কোনবারই হতাশ হতে হয়নি রঙদের। সর্বোচ্চ ২য় ঘন্টার পর ছুটি পেয়ে যেত। তাক্‌ ধি না ধিন্‌ করে নাচতে নাচতে বাসায় চলে আসত রঙ। শিখাদি, অপুদি আর চম্পার সাথে লুডু খেলা যেত জম্পেশ করে। রবি দাদুর বাড়ি থেকে গরম গরম ভাজা বাদাম কিনে খেতে খেতে, টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে লুডু খেলা কী মজারই না ছিল!

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাছুটির ('অটো') চাইতেও আজকের ছুটি ভিন্ন ধরনের।

মনে পড়ে- প্রথমবার যেদিন তারা অটো নেয়, সেদিন ছিল বিশ্বকাপের প্রথম দিন। অটোর পর উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। কম্পিউটারে হাই ভলিউমে গান চালিয়ে দিয়ে তাস পিটাচ্ছিল রঙ ও তার কয়েকজন বন্ধু। শেষ পর্যন্ত সেই অটো ভাল কাটেনি রঙের। সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক আপু মারা গিয়েছিলেন সেদিন। গন্ডগোলে দু' মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও তেমন ছুটি কোনদিন চায় না রঙ।

প্রক্সির চেয়েও স্বতন্ত্র আজকের ছুটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে রঙ প্রায়ই অন্যদের প্রক্সি দিয়ে দিত। একবারতো ফুরিয়ার সিরিজ স্যারের ক্লাসে এক মেয়ের প্রক্সিও দিয়ে দিয়েছিল! রঙ নিজে যেমন অন্যের প্রক্সি দিত, তেমনি অন্যরাও তার প্রক্সি দিয়ে দিত প্রায়ই। বহুদিন বাঙ মেরে ক্যাফেতে তাস খেলেছে সে, কিন্তু ক্লাসের উপস্থিতি খাতায় অনুপস্থিত থাকেনি খুব একটা।

এমনকি চাকরিতে ঢুকার পরে বিনা কারণে অফিস ফাঁকি দিয়েও এত মজা পায়নি রঙ। বরং ছুটির দিনগুলোতে করার মত কিছু না পেয়ে প্রতিবারই বিরক্ত হয়েছে সে। শেষে ভেবেছে- অফিসে গেলেই বরং ভাল হত!

তাইতো আজকের ছুটিটা অন্যরকম।

অফিস থেকে আজ সে ছুটি নিয়েছে বই পড়ার জন্য। বইমেলা থেকে বেশ কিছু বই কিনেছে, পড়া হয়নি। বই পড়ার অভ্যেসটা চলে গেছে বলে প্রায়ই আফসোস করত রঙ, আর ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেত। অভ্যেসটা আজ আবার ফিরে এসেছে। সকালে উঠেই মনে হয়েছে আজ তার বই পড়ার দিন। অফিসের শৃঙ্খল থেকে মনকে মুক্তি দেয়ার দিন। আজ তার জাগরণের দিন। মনটা নেচে উঠেছে কি? তাক্‌ ধি না ধিন্‌ ...

Friday, February 26, 2010

এসো, গণিত শিখি

১.
মেজাজটাই চড়ে গেল পল্লবের। কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের মুখে এমন কথা শুনলে মেজাজের আর দোষ কি? বলে কি না- "দুয়েকটা কঠিক অংক মুখস্থ করলে কিচ্ছু হয় না"। পল্লবকে দেখে কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না যে সে এত ক্ষেপে আছে। সে নড়েচড়ে ঘাড় সোজা করে সোফায় হালকা হেলান দিয়ে বসে। হাত দুটো একসাথে মুঠো করে শক্ত করে ধরে রাখে। পল্লবের ভিতরে যত রাগ তার সবটুকু উত্তাপ বয়ে যায় দুই হাতের ঐ শক্ত মুঠোর উপর দিয়ে। মুহুর্তের জন্য চুপ থেকে, গলার স্বর স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নামিয়ে, অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ ভাষায় ধীর লয়ে বলতে থাকে - "মুখস্থ করলে তোমার ছেলে নম্বর ঠিকই পাবে, কিন্তু অংক শিখবে না কোনদিন।"

বুয়েটে পড়া পল্লবের এমন গুরুগম্ভীর কথা ফেলে দিতে পারে না তার মেসো (খালু) সহকারী অধ্যাপক অনীল দত্ত। চুপ থেকে পল্লবকে তার কথা শেষ করতে দেয়- "অংক মুখস্থ করে তোমার ছেলে ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত হয়তো হাইয়েস্ট নম্বরও পাবে, তবে এরপর আর না। আমি এ কথা খাতা-কলমে লিখে দিতে পারি।"

আস্তে আস্তে গলা উঁচুতে উঠতে থাকে পল্লবের, ভাষার শুদ্ধতাও কমতে থাকে। তর্জনী উঁচিয়ে ক্লাশ ফোরে পড়া পলককে উদ্দেশ্য করে বলে- "শোন্‌, তোর বাপে যতই অংক মুখস্থ করতে কউক, তুই জীবনে অংক মুখস্থ করবি না। নাম্বার কম পাইলে পা, তাও মুখস্থ করবি না। নাম্বার দিয়ে গাডা খাবি নাকি?"

পলুদাকে দারুণ পছন্দ পলকের। মায়ের কাছে পলুদার গল্প শুনতে শুনতে তাকেই পড়ালেখার আদর্শ ধরে নিয়েছে মনে মনে। তাই রাগী আর বদমেজাজী বাবার কথাকেও এখন সে পাত্তা দেয় না। পলুদার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে-"আইচ্ছা"।

ঘটনা হয়েছে- ২য় সাময়িক পরীক্ষায় পলক অংকে ৮০ এর মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৫২। ক্লাস টেস্টের বাকি ২০ এর মধ্যে পেয়েছিল ১৫। ক্লাসে তাই তার অবস্থান এখন ৩ থেকে ৮ এ চলে গেছে। অনীল দত্তের বিশেষ উৎকন্ঠা সে কারণেই।  ছুটিতে বেড়াতে এলে তাই পল্লবকে ডেকে মাসি বীণা দত্ত চুপি চুপি বলেন- "ভাইডারে ইট্টু বুঝাইয়া দে না, বাবা। কেমনে পড়তে অইব দেহাইয়া দিয়া যা। ইট্টুও পড়ে না রে...। তুই কইয়া দিয়া যা, তর কথা শুনব।"

পল্লব চুপ করে শোনে। সে জানে পলক তাকে ভীষণ পছন্দ করে। সে নিজেও একটু বেশিই আদর করে এই ভাইটাকে, একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয়।

২.
বিকেলে পলককে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে পল্লব। মূল উদ্দেশ্য পলককে কিছুটা জ্ঞান দেয়া। কিন্তু খালি খালি উপদেশ সে শুনবে কেন? তাই পল্লব ঠিক করেছে আগে তাকে খাওয়াবে, তার সাথে গল্প করবে, তারপর কোন এক কথার সূত্র ধরে পড়ালেখার কথা নিয়ে আসবে। বাজারের কাছাকাছি আসতেই পল্লব বলে- "আজকা তোরে খাওয়ামু। কী খাবি ক।"

পলক বলার মত বিশেষ কথা খুঁজে পায়- "জান পলুদা... আঙ্গ লগের বাইত বিশুদা আছে না... হেয় না বাজারঅ দোহান দিছে।" [জান পলুদা, আমাদের বাড়ির পাশে যে বিশুদা আছে সে বাজারে দোকান দিয়েছে।] "পুরি-সিংগারার দোহান, যদি খাইতা... ক-ঠি-ন টেস্ট"।

পল্লব মুচকি মচকি হাসে- পিচ্চিটা এরই মধ্যে তার কাছ থেকে 'কঠিন' শব্দটা শিখে নিয়েছে। বলে- "চল্‌ তাইলে বিশুর দোহানেই"।

দুই ভাই মিলে বিশুর দোকানে যায়। পল্লবকে দেখে বিশু বিশেষ খাতির করে খাওয়ায়। সত্যিই বেশ মজাদার খাবার, বিশেষ করে আলুর চপটা- ভিতরে খানিকটা মুরগির মাংস দেয়া। মাংসের ঝোল দিয়ে খেতে আসলেই ক-ঠি-ন টেস্ট!

খেয়ে দেয়ে রেললাইনের দিকে হাঁটতে থাকে দুজনে। নীরবতা ভাঙ্গে পলকের আগ্রহে - "আইচ্ছা পলুদা, তুমি বলে ছুডবেলায় বান্দর আছিলা?"

পল্লব বুঝতে পারে- বীণা মাসি তার গল্প বেশ ভালভাবেই করেছে। হাসতে হাসতে বলে- "হ, আছিলাম তো, তোরে কইল কেডা?"

উত্তর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না পলক। আবার জিজ্ঞেস করে- "তুমি বলে বান্দরামি কইরাও ঠিকমত পড়াশুনা করতা?"

"আমি পড়াশুনা করতাম কম, তয় যতটুকু পড়তাম মন দিয়া পড়তাম, বুইঝা পড়তাম, আর নিয়মিত পড়তাম।" আসল উদ্দেশ্য কিছুটা সফল করতে পেরে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পল্লব।

পলকের কৌতুহল বাড়ে - "এত কম পইড়াও অংকে এত ভালা করতা কেমনে?"

এবার পল্লব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে থাকে- "অংক হইল একটা সোজা জিনিস। এইটা মুখস্থ করতে যাবি- মনে হইব বি-শা-ল কঠিন জিনিস। কিন্তু বুইঝা করবি- দেখবি কত্ত সোজা।" পল্লব খেয়াল করে পলক ঠিক বিশ্বাস করছে না কথাগুলো, কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তাকে তার আশেপাশের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে।

-ধর, তুই এক ধরনের অংক শিখলি আজকা। এহন তুই আশেপাশে খুঁজবি- এই অংকটা কামে লাগে কই? তুই যোগ অংক পারস না?
- হ, পারি।
- আইচ্ছা ক তো বিশুর দোহান দিতে কত টেয়া (টাকা) লাগছে?
- আমি কেমনে কমু? জিগাইছি নি কোনদিন?
- ল (চল), আমরা আন্দাজ করি। ধর- টেবিল গুলার দাম ১০ হাজার টেয়া, চেয়ার গুলা ৫ হাজার। দুইডা মিল্লা কত অইল?
- ১৫ হাজার।
- আর মনে কর চুলাডার দাম ৩ হাজার। পেলেট-টেলেট আরো ৩ হাজার। কড়াইডা দেড় হাজার।

ইচ্ছে করেই পল্লব হিসাবের মধ্যে 'দেড়' ঢুকিয়ে দেয়। পলক হিসাব কষতে থাকে - "পনের আর তিন মিল্লা আঠার। আঠার আর তিনে একুশ। একুশ আর দেড়... বাইশ... সাড়ে বাইশ।"

হিসাবের স্বচ্ছতা দেখে পল্লব খুশি হয়। বুঝতে পারে- এই পিচ্চির বেসিক ভালই। এবার গুণ অংক ধরিয়ে দেয়-

- সাথে ধর ঘর ভাড়া প্রত্যেক মাসে ২ হাজার কইরা ৬ মাসের অগ্রিম। ৬ মাসের ভাড়া কত হয় রে?

ফিসফিস করে গুণের নামতে পড়তে থাকে পলক- "দুই একে দুই, দুই দুগুনে চাইর, তিন দুগুনে ছয়, চাইর দুগুনে আট, পাচ দুগুনে দশ, ছয় দুগুনে বার... বার হাজার!"

- মোট কত হইল?

এবার একটু ঝামেলায় পড়ে বেচারা, আমতা আমতা করতে থাকে। সহজ করে দেয় পল্লব- "আগে সাড়ে ২২ আছিল না? অইডার অর্ধেক হাতে রাইখা দে। বাকি ২২ এর লগে এই ১২ যোগ কর। কত হয়?"

আঙ্গুলে গুণতে থাকে ক্ষুদে গণিতবিদ।

- বাইশ আর বার। তেইশ, চব্বিশ, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪... চৌত্রিশ।
- এইবার হাতের অর্ধেক যোগ কর।
- সাড়ে চৌত্রিশ।
- তাইলে নতুন দোহান দিতে বিশুর কয় টেয়া লাগছে?
- সাড়ে চৌত্রিশ হাজার!
- এইতো হইছে! সাব্বাস! যাহ্‌! তোরে একটা মিমি চকলেট দিমুনে।

পল্লব জ্ঞান দিয়ে যেতে থাকে- "ইমুন কইরা তোর আশেপাশের জিনিস দেইখা তুই নিজে নিজেই অংক বানাবি, নিজেই করবি। তাইলেই দেখবি অংক তোর কাছে সহজ হইয়া যাইব।"

পল্লবের কথায় বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে পলকের।

৩.
পলক আজকে অন্যরকম খুশি। ঢাকায় এসেছে আজ। ঢাকায় আসার মূল কারণ যদিও কাকাত বোনের বিয়ে, পলকের খুশি হওয়ার মূল কারণ অবশ্য তা নয়- বরং পলুদার সাথে শিশুপার্ক আর জাদুঘর দেখাই বেশি মজার মনে হয় তার। দুইদিন আগে থেকেই সে বারবার ফোন করে পল্লবকে মনে করিয়ে দিয়েছে- আজ সকালে যেন একটুও দেরি না হয়, পারলে ভোরেই যেন তাকে কাকার বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। বেশ উত্তেজনা হচ্ছে পলকের। বুয়েট দেখা হবে আজ। গোপনে গোপনে সে একটা স্বপ্ন লালন করে- "পলুদার মত আমিও একদিন বুয়েটে পড়ব"।

বুয়েটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল ১০ টা বেজে ১০। নজরুল ইসলাম হলের ৩২৩ নম্বর রুম। রুমে ঢুকেই বিস্মিত হওয়ার পালা- এত বেলা হল, অথচ এখনো ঘুমোচ্ছে একজন! উফ্‌ , এত নোংরা হতে পারে একটা রুম? সমস্ত রুম জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো বই - গল্পের বই-ই বেশি। তিন-তিনটে কম্পিউটারের তারগুলো প্যাঁচ খেয়ে আছে ভীষণ, জীবনেও খুলবে কিনা সন্দেহ। মাকড়শার ঝুল জমে আছে দেয়ালের কোনায় কোনায়। মেঝে দেখলে মনে হয় তা মুছা হয়নি কোনদিন। অন্য সব বুয়েট-মুগ্ধ মানুষের মতো পলকও এই অগোছালো ভাবের পিছনে একটা কারণ খুঁজে পায়- বুয়েটের ছাত্ররা অনেক পড়াশুনা করে তো, ঘর গোছানোর এত সময় কোথায় তাদের!

সকালটা কাটল কম্পিউটার নিয়ে। আগেও কম্পিউটার ব্যবহার করেছে পলক, তবে এতটা সময় জুড়ে এই প্রথম। গেম্‌স্‌ আর খেলোয়াড়ের ছবির দিকেই আগ্রহ বেশি। বিশেষ করে শচীন আর সাকিবের ছবি যতই দেখে আশা মেটে না। পল্লব ইন্টারনেট থেকে ছবি ডাউনলোড করে দেখায়। কিন্তু এত সময় লাগে যে সে জিজ্ঞেস কর- "ছবিগুলা আছে কৈ? তুমি নিজে গিয়া নিয়া আইতে পার না?"।

ছোট্ট এই ছেলের কৌতুহলী প্রশ্নে থতমত খায় পল্লব। কী বলবে ভাবতে সময় নেয় কিছুটা- "এই ছবিগুলা আসতাছে বিদেশ-তে- কোনটা ইন্ডিয়ারতে, আবার কোনটা এমেরিকারতে। ছবিগুলা আসতে সময়তো একটু লাগবোই"।
- আর এই কম্পিউটার?
- কম্পিউটারের বিভিন্ন পার্টস বিভিন্ন দেশ থেইকা আসে। চীন, মালয়েশিয়া, আমেরিকা এইসব দেশ থেইকা।
- আইচ্ছা, অইসব দেশে কি A, B, C, D উল্ডাপাল্ডা? আঙ্গ (আমাদের) মত না?

ভুরু কুচকায় পল্লব। এই পিচ্চি বলে কী! তবে উত্তর দিয়ে যায়- "উল্ডাপাল্ডা হইব কেন? আম্‌গ মতই।"
- তাইলে কীবোর্ডে উল্ডাপাল্ডা A, B, C, D কে? ঠিক কইরা বসাইতে পারে না?

হা হা হো হো করে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নেয় পল্লব। এই তাহলে কাহিনী! হাসির দমক থামিয়ে অভিনব প্রশ্নকর্তাকে সহজভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে - "A,B,C,D গুলার মধ্যে কিছু কিছু অক্ষর বেশি কামে লাগে, আর কিছু কিছু কম। যেমন- A,S এইগুলা বেশি বেশি কামে লাগে, আর Q,W,X এইগুলা কম কামে লাগে।  তো, টাইপ করার সময় বেশি কামের অক্ষরগুলা যাতে আঙ্গুলের কাছে কাছে থাকে, অইরম কইরা সাজাইতে গিয়া A,B,C,D গুলা উল্ডাপাল্ডা হইয়া গেছেগা।" কীবোর্ডে আঙ্গুল রেখে বুঝিয়ে দেয় পল্লব। তখন ছুটে আসে অন্য প্রশ্ন- "তোমার কম্পিউটারেতো খালি ইংলিশ অক্ষর, বাংলা নাই?"

এইবার বেশ আগ্রহের সাথে পল্লব উত্তর দেয়- "হ্যাঁ, আছে!" বলেই একটা ব্লগ সাইট, আর দুইটা বাংলা পত্রিকার সাইট খুলে দেখায়। খুশি হয়ে যায় পলক- "আরে! কম্পিউটারের ভিতরে পত্রিকা। কী মজা! আমি পত্রিকা পড়মু।"

বাঁধা দেয় পল্লব- "এখন না, আগে চল খাইতে যাই। এরপর জাদুঘর আর শিশুপার্ক। এখন না বাইর হইলে দেরি হইয়া যাইব।"

মেনে নেয় পলক- "আইচ্ছা, ঠিক আছে, আইয়া দেখমু নে।"


৪.
দুপুরে কেন্টিন বন্ধ, খাওয়ার জন্য ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে হবে। হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিয়েই তাজ্জব বনে গেল পলক- গাড়ির ভিতরে বই! পল্লবকে জিজ্ঞেস করে- "ঐ গাড়িটার ভিতরে এত বই কেন্‌? বাড়ি বদলায় নাকি? হেই বাড়ির লোকজন মনে হয় বেশি পন্ডিত।"

বক্রোক্তিটা নজর কাড়ল পল্লবের। সে হাসল, কিন্তু কিছু বলল না, বরং গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। পলক খেয়াল করল- গাড়ির সামনের কাচে লেখা "আলোকিত মানুষ চাই"। পলুদার কাছ থেকে জেনে নিল- এটা একটা লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি-গাড়িটা প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বুয়েটের স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে আসে। এখানের ছেলে-মেয়েরা যারা এই গাড়ির সদস্য, তারা এক সপ্তাহের জন্য দুইটা করে বই নিতে পারে। বইগুলো পড়া শেষ হয়ে গেলে পরের সপ্তাহে আবার দুইটা বই। এভাবেই চলে।

পলক গাড়ির ভিতর ঢুকে নন্টে-ফন্টের বই খুঁজল, কিন্তু বিধি বাম, পেল না। গাড়ি থেকে বের হয়েই তাই সে বলে- "আমি বড় হইয়া যখন একটা লাইব্রেরি দিমু, তখন অইখানে নন্টে-ফন্টের বই রাখমু।"

তারপর কী যেন ভাবে- "আইচ্ছা পলুদা, আঙ্গ বাড়ির দিগে ইমুন লাইব্রেরি অইতে পারে না?"

উত্তরের আশা করে না সে। বরং চিন্তিত হয়ে পড়ে- "বহুত টাকা লাগবো, না?"
- "হুম, টাকাতো লাগবেই।" দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পল্লব।
- আইয়ো, অংক কইরা বাইর করি কত টাকা লাগবো। কওছে গাড়ির মইধ্যে বই আছে কয়ডা?- পলকের অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন।
- কয়েক হাজার।
- ধরলাম ৩ হাজার। একেকটার দাম কত কইরা?
- ১০০ কইরা ধর।
- তিনশ হাজার... তিন লাখ।
- আর গাড়ির দাম কত?
- খাইছে, তুই গাড়ি কিনবি নাকি??
- আরে, কও না!
- বাসের দাম তো ঠিক জানি না, হইব ১৫-২০ লাখ।
- যাও, ধরলাম ২০ লাখ। ২০ আর ৩ মিল্লা ২৩।
- আর খরচ কী আছে?
- ড্রাইভারের খরচ, তেল খরচ, লাইব্রেরি কার্ডের খরচ।
- এইতান সব কিছু ২ লাখের মইধ্যে অইত না?
- হইয়া আরো বেশি হইব।
- তাইলে ২৫ লাখ টেয়া অইলে ইমুন একটা গাড়ি-লাইব্রেরি দেওন যাইব।

আফসোস পলকের - ইস্‌ কেউঐ যদি টেয়াডা দিয়া দিত!


৫.
ডাইনোসরটা ছাড়া জাদুঘরের আর কিছু ভাল লাগেনি পলকের। শিশুপার্কটাই বেশি ভাল। রেলগাড়িতে চড়েছে তিন বার। চড়কি যখন এক্কেবারে উঁচুতে, ভালই ভয় পেয়েছে তখন; কথাবার্তা না বলে চুপ করে শক্ত হয়ে বসে ছিল। বসে বসে ঘুরায় যেটা, নাম যেন কী রাইডটার, ঐটাও বেশ ভাল লেগেছে। বিমান, ঘোড়ার গাড়ি, নাগরদোলা সবই ভাল লেগেছে কম-বেশি। পার্ক থেকে বের হয়ে চটপটি আর আইসক্রীম খেয়ে সন্ধ্যার আগেই আবার হলে ফিরে এসেছে। এসেই দাবি- "পেপার আইনা দেও, পেপার পড়মু।"

কম্পিউটারের ভিতর পেপার, মজাই আলাদা। পল্লব পলককে পেপার পড়তে দিয়ে হাতমুখ ধুতে যায়। হাতমুখ ধুয়ে যখন রুমে ফিরে তখন পলক বলে- "পলুদা, অন্যদিনতো তুমি আমারে অংক দেও। আজকা আমি তোমারে একটা অংক দেই। বিশুদার দোহান দিতে খরচ হয় সাড়ে চৌত্রিশ হাজার টাকা। একটা গাড়ি-লাইব্রেরি দিতে লাগে ২৫ লাখ টাকা। আর বিমানবন্দরের নাম পাল্ডাইতে খরচ অয় ১২০০ কোটি টাকা। তাইলে কও তো- বিমানবন্দরের নাম পাল্ডানের টেয়া দিয়া কয়ডা বিশুদার দোহান দিওন যাইবো? কয়ডা গাড়ি-লাইব্রেরি দেওন যাইবো?"

পল্লবের অংক মিলে না।

Monday, February 22, 2010

কবে যে পুরুষগুলো মানুষ হবে

"ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া, বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে..." - ৬ নম্বর বাসে "তিল ঠাঁই আর নাহিরে"- পরিমাণ ভিড়ের মধ্যে এমন কর্কশ আওয়াজের মধুর সংগীত আপনার নজর কাড়বেই। আমারও কেড়েছে। উৎসের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতে পারি নকিয়া-১১০০ গোত্রের মুঠোফোন নিঃসৃত এ ধ্বনি।

- হ্যালো, স্লামালিকুম।

মিহি সুর শুনে আন্দাজ করা যায় - উনি তরুণী না হলেও মধ্যবয়স্ক হবেন না। একই সুরে আবার -

- ওয়ালাইকুম সালাম।

সম্ভবতঃ ওপাশ থেকেও আবার স্লামালিকুম দেয়া হয়েছে। চিকন সুরের বিরক্তি ভরা কন্ঠ সঙ্গী করে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে বাস।

- আপনি কে বলছেন সেটা বলেন আগে।
- জায়গা দিয়ে কি করবেন? কাকে চাচ্ছেন বলেন।
- এটা ঢাকা।
- ঢাকার কোন্‌ জায়গা তা জানার দরকার নেই। কাকে চাচ্ছেন বলেন।
- আরে ভাই আপনি কে?
- কি নাম? আবার বলেন।
- না, আপনাকে চিনতে পারলাম না।
- না, এই নামে কেউ থাকে না এখানে।
- বললাম তো এই নামে কেউ থাকে না এখানে।
- আমার নাম জেনে আপনার কি?
- আবার জায়গা... জায়গা দিয়ে কি করবেন? এটা ঢাকা।
- আপনি রং নাম্বারে ফোন করেছেন।
- আমার নাম্বার আপনার ডায়াল লিস্টে আছে।
- আমার কন্ঠ সুন্দর তাতে কি?

এই কর্মক্লান্ত বিকেলে ভদ্রমহিলার মনোজগতের কথা কল্পনা করতে মনোবিজ্ঞানী হতে হয় না।

এদিকে বাসটা সামনে এগোতে জোর চেষ্টা করছে। যথারীতি স্বাভাবিক ফলশ্রুতি- অতীব জোরের ব্রেক... আরো স্বাভাবিক পরিণাম- কিছু যাত্রীর সামনের দিকে হেলে গিয়ে পড়ি-মরি অবস্থা। এরই মাঝে আবার আমাদের নজর চলে যায় কর্কশ আওয়াজের মধুর সংগীতের দিকে - "ওরে নীল দরিয়া..."

Saturday, February 20, 2010

এমনই হয়...

আমাদের ঘরের পাশেই 'মিষ্টি' আম গাছটা ছিল। পাশে না, পাশে না। ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতরই তো! না হলে বারান্দাটা ঐ কোণে এসে বেঁকে গেল কেন? আমাদের বারান্দাটা গাছটাকে একদম দেখতে পারত না, আর আমাদের সবার প্রতি ভীষণ ক্ষোভ তার। গাছটার প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বের কারণে বাড়ির ডিজাইনের মাঝে গাছটা এসে পড়লেও তা আর কাটা হয়নি, বরং ছেঁটে দেয়া হয়েছে হতভাগা বারান্দাকে। আর আমরা গাছটার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হবোই না কেন? যা মিষ্টি ছিল আমগুলো! আহা, এখনো জিবে স্বাদ পাই! সে কারণেই তো তার নাম আমরা দিয়েছিলাম - 'মিষ্টি'।

আমাদের বাড়িতে যে পাঁচটা আম গাছ ছিল প্রত্যেকেরই একটা করে নাম ছিল - মিষ্টি, সিঁদুরে, চ্যাপ্টা, টুইরা আর জর্ণা। সিঁদুরে গাছের আম একটু বড় হলেই সিঁদুরে লাল রংয়ের হত। কী সুন্দর যে রং! কী আর বলব। আমি ঐ গাছের আম না খেয়ে রেখে দিতাম। আগে বন্ধুদের দেখাতাম, পরে খেতাম। চ্যাপ্টা গাছটা ভীষণ লম্বা হলেও আমগুলো ছিল চ্যাপ্টা। আঁটিও ছিল ছোট। আর স্বাদের দিক দিয়ে মিষ্টির পরেই সে। তবে ফলন অন্যদের চেয়ে বেশি হওয়ায় চ্যাপ্টাই ছিল আমাদের আমক্ষুধা মেটানোর প্রধান অবলম্বন। টুইরা গাছটা ছিল ছোটখাট গড়নের। কাচা থাকে অবস্থায় অসম্ভব টক থাকত আমগুলো। কিন্তু পাকলে সেগুলোই কেমনে করে যেন মিষ্টি হয়ে যেত! তখন পোকার জ্বালায় আম খেতে বড়ই কষ্ট লাগত। জর্ণা গাছটার আমগুলো দেখতে সুন্দর। হলদে রং-এর উপর ছোপছোপ লাল ফোঁটার আমগুলোতে এক ধরনের গন্ধ থাকত। ঐ গন্ধকে নাকি 'জর্ণা' গন্ধ বলে। আমি আজ পর্যন্ত এই আম গাছ ছাড়া আর কোথাও 'জর্ণা' শব্দটার প্রয়োগ দেখিনি, এমনকি জানিওনা আসলেই শব্দটা প্রমিত বাংলা ভাষায় আছে কি না। জর্ণা গন্ধের কারণেই বাড়িতে অন্য কোন আম থাকলে জর্ণার দিকে আমরা হাত দিতাম না একেবারেই।

সম্ভবত ১৯৯১ সালের কথা। প্রচন্ড ঝড়ে 'মিষ্টি' আম গাছের একটা বড় অংশ ভেঙ্গে পড়ল আমাদের ঘরের চালে। যা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন! ভেবেছিলাম ঘরটা বুঝি ভেঙ্গেই গেল। না ঘর ভাঙ্গেনি, তবে চালের টিন একেবারে বসে গিয়েছিল। মিস্ত্রি ডেকে চাল ঠিক করাতে হয়েছিল। একেতো ঝড়ে আমগাছটা ছোট হয়ে গেছে, আবার একই সাথে আমাদের ঘরের জন্য সেটা হুমকিস্বরূপ - এই দুই কারণে আমাদের পক্ষপাতিত্বও গাছটাকে কেটে ফেলা থেকে রক্ষা করতে পারল না। গাছের মৃত্যুতে বারান্দাও কষ্ট পেয়েছিল ভীষণ। 'মিষ্টি'-র অনুপস্থিতি বারান্দার অপূর্ণতাটুকুকে তুলে ধরল নগ্নভাবে।

সিঁদুরে আর টুইরা দুটোই মরেছিল বয়সের কারণে। আর চ্যাপ্টা, মিষ্টির মৃত্যুর পর যে ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু, তার মৃত্যু ছিল সবচেয়ে করুণ। আমাদের বাড়ির সামনের খালি জমিটা দিয়ে আমরা মূল রাস্তায় উঠতাম। সেটি যখন বিক্রি হয়ে গেল, তখন নতুন মালিক সে জমির চারপাশে দেয়াল দিতে চাইলে রাস্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল চরমভাবে। আর রাস্তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে আত্মত্যাগ করতে হল চ্যাপ্টাকেই। চ্যাপ্টার এক সন্তান এখন আমাদের বাড়িতে আছে। মায়ের গুণটুকু পনের আনাই ধরে রেখেছে; তবে আকারে লম্বা নয় মোটেও, ছোটখাট।

আর জর্ণা গাছটা, যে গাছটার আম আমরা পারতপক্ষে খেতে চাইতাম না, সেটা টিকে আছে এখনও। টিকে আছে সদম্ভে।

এমনই হয়। ছাত্ররাজনীতির যে অংশ নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল তার মৃত্যু হয়েছে অনেকদিন আগেই। আর সদর্পে টিকে আছে লেজুরবৃত্তিকারী অংশটুকু! আর বকররা প্রাণ হারায় অকালে...