Saturday, February 20, 2010

এমনই হয়...

আমাদের ঘরের পাশেই 'মিষ্টি' আম গাছটা ছিল। পাশে না, পাশে না। ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতরই তো! না হলে বারান্দাটা ঐ কোণে এসে বেঁকে গেল কেন? আমাদের বারান্দাটা গাছটাকে একদম দেখতে পারত না, আর আমাদের সবার প্রতি ভীষণ ক্ষোভ তার। গাছটার প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বের কারণে বাড়ির ডিজাইনের মাঝে গাছটা এসে পড়লেও তা আর কাটা হয়নি, বরং ছেঁটে দেয়া হয়েছে হতভাগা বারান্দাকে। আর আমরা গাছটার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হবোই না কেন? যা মিষ্টি ছিল আমগুলো! আহা, এখনো জিবে স্বাদ পাই! সে কারণেই তো তার নাম আমরা দিয়েছিলাম - 'মিষ্টি'।

আমাদের বাড়িতে যে পাঁচটা আম গাছ ছিল প্রত্যেকেরই একটা করে নাম ছিল - মিষ্টি, সিঁদুরে, চ্যাপ্টা, টুইরা আর জর্ণা। সিঁদুরে গাছের আম একটু বড় হলেই সিঁদুরে লাল রংয়ের হত। কী সুন্দর যে রং! কী আর বলব। আমি ঐ গাছের আম না খেয়ে রেখে দিতাম। আগে বন্ধুদের দেখাতাম, পরে খেতাম। চ্যাপ্টা গাছটা ভীষণ লম্বা হলেও আমগুলো ছিল চ্যাপ্টা। আঁটিও ছিল ছোট। আর স্বাদের দিক দিয়ে মিষ্টির পরেই সে। তবে ফলন অন্যদের চেয়ে বেশি হওয়ায় চ্যাপ্টাই ছিল আমাদের আমক্ষুধা মেটানোর প্রধান অবলম্বন। টুইরা গাছটা ছিল ছোটখাট গড়নের। কাচা থাকে অবস্থায় অসম্ভব টক থাকত আমগুলো। কিন্তু পাকলে সেগুলোই কেমনে করে যেন মিষ্টি হয়ে যেত! তখন পোকার জ্বালায় আম খেতে বড়ই কষ্ট লাগত। জর্ণা গাছটার আমগুলো দেখতে সুন্দর। হলদে রং-এর উপর ছোপছোপ লাল ফোঁটার আমগুলোতে এক ধরনের গন্ধ থাকত। ঐ গন্ধকে নাকি 'জর্ণা' গন্ধ বলে। আমি আজ পর্যন্ত এই আম গাছ ছাড়া আর কোথাও 'জর্ণা' শব্দটার প্রয়োগ দেখিনি, এমনকি জানিওনা আসলেই শব্দটা প্রমিত বাংলা ভাষায় আছে কি না। জর্ণা গন্ধের কারণেই বাড়িতে অন্য কোন আম থাকলে জর্ণার দিকে আমরা হাত দিতাম না একেবারেই।

সম্ভবত ১৯৯১ সালের কথা। প্রচন্ড ঝড়ে 'মিষ্টি' আম গাছের একটা বড় অংশ ভেঙ্গে পড়ল আমাদের ঘরের চালে। যা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন! ভেবেছিলাম ঘরটা বুঝি ভেঙ্গেই গেল। না ঘর ভাঙ্গেনি, তবে চালের টিন একেবারে বসে গিয়েছিল। মিস্ত্রি ডেকে চাল ঠিক করাতে হয়েছিল। একেতো ঝড়ে আমগাছটা ছোট হয়ে গেছে, আবার একই সাথে আমাদের ঘরের জন্য সেটা হুমকিস্বরূপ - এই দুই কারণে আমাদের পক্ষপাতিত্বও গাছটাকে কেটে ফেলা থেকে রক্ষা করতে পারল না। গাছের মৃত্যুতে বারান্দাও কষ্ট পেয়েছিল ভীষণ। 'মিষ্টি'-র অনুপস্থিতি বারান্দার অপূর্ণতাটুকুকে তুলে ধরল নগ্নভাবে।

সিঁদুরে আর টুইরা দুটোই মরেছিল বয়সের কারণে। আর চ্যাপ্টা, মিষ্টির মৃত্যুর পর যে ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু, তার মৃত্যু ছিল সবচেয়ে করুণ। আমাদের বাড়ির সামনের খালি জমিটা দিয়ে আমরা মূল রাস্তায় উঠতাম। সেটি যখন বিক্রি হয়ে গেল, তখন নতুন মালিক সে জমির চারপাশে দেয়াল দিতে চাইলে রাস্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল চরমভাবে। আর রাস্তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে আত্মত্যাগ করতে হল চ্যাপ্টাকেই। চ্যাপ্টার এক সন্তান এখন আমাদের বাড়িতে আছে। মায়ের গুণটুকু পনের আনাই ধরে রেখেছে; তবে আকারে লম্বা নয় মোটেও, ছোটখাট।

আর জর্ণা গাছটা, যে গাছটার আম আমরা পারতপক্ষে খেতে চাইতাম না, সেটা টিকে আছে এখনও। টিকে আছে সদম্ভে।

এমনই হয়। ছাত্ররাজনীতির যে অংশ নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল তার মৃত্যু হয়েছে অনেকদিন আগেই। আর সদর্পে টিকে আছে লেজুরবৃত্তিকারী অংশটুকু! আর বকররা প্রাণ হারায় অকালে...

No comments: