Friday, August 3, 2012

জীবনের গল্প (পর্ব-২)

জীবনের গল্পের শুরুর দিকের কাহিনী ভুলে গেছেন নিশ্চয়। সেটাই স্বাভাবিক, সমস্যা নাই, একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। মানুষসহ যেকোন জীবের জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে কোষের মাঝে, যা আবিষ্কার করেছিলেন রবার্ট ব্রাউন সেই ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এর ২০০ বছর পর গ্রেগর জোহান মেন্ডেল নামের এক ধর্মযাজক ১৮৬৫ সালে মটরশুটি চাষের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তত্ত্ব প্রদান করেন যে, প্রজাতির বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘জীন’ দায়ী। প্রতিটা বৈশিষ্ট্যের জন্য এই জীনের ২টা অংশ থাকে - একটা অংশ আসে মায়ের কাছ থেকে, আরেকটা বাবার কাছ থেকে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মেন্ডেল কিন্তু স্বচক্ষে জীন দেখেননি, বরং যা বংশগতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তারই নাম দিয়েছিলেন জীন। এরও প্রায় ৫০ বছর পর বিজ্ঞানী মরগ্যান বের করলেন যে, জীন অর্থাৎ বংশগতির ধারক থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ক্রোমোজোমের ভিতরে। মা ও বাবার ক্রোমোজোমের মধ্যে ক্রস-ওভারের ফলে সন্তান-সন্ততিরা মিশ্র বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে।

জীনের কাজ কি তা বের হলো যেভাবে


যে কথা বলছিলাম, ১৯৪০ সালের শুরুর দিকেও বিজ্ঞানীরা জানতেন না জীন কী দিয়ে তৈরি, এর কাজই বা কি। একে একে নানান মজার মজার ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে জেনেছেন তারা। এমনই এক মজার পরীক্ষার মাধ্যমে বিডল আর ট্যাটম জীনের কাজ কি তা বের করেছেন ১৯৪১ সালে। তাদের পরীক্ষা Neurospora নামের রুটির ছত্রাক নিয়ে। এই ছত্রাক কেবল চিনি (সুক্রোজ) আর লবণ পেলেই বেঁচে থাকতে ও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। এই দুই বিজ্ঞানী করলেন কি, ছত্রাকের উপর এক্স-রে ফেললেন। তাতে হলো কি, ছত্রাকের বংশবৃদ্ধি থেমে গেল। এতে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, এক্স-রে নিশ্চয় এমন কোন জীন মেরে ফেলেছে যা বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এখানেই তারা থামলেন না। তারা জানতেন যে, চিনি আর লবণ থেকে অ্যামিনো এসিডসহ জীবের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করার জন্য যে ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রয়োজন, তা করা যায় প্রোটিন বা এনজাইমের সাহায্যে। তাই তারা বংশবৃদ্ধি বন্ধ হওয়া ছত্রাককে ভিটামিন বি-৬ খাওয়ালেন। আশ্চর্যের সাথে লক্ষ করলেন যে, ছত্রাকগুলো কেবল পুনরায় বংশবৃদ্ধি শুরু করেনি, বৃদ্ধির হারও অনেক বেড়েছে। এর সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা ছিল এমন - এক্স-রে নিশ্চয় এমন কোন জীন মেরে ফেলেছে যা ভিটামিন বি-৬ সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করত। সব মিলিয়ে মানে দাঁড়াল, জীনের কাজ হচ্ছে প্রোটিন তৈরি করা! এত সহজ আর মজার পরীক্ষার মাধ্যমে তারা আবিষ্কার করে ফেললেন জীবনের অন্যতম এক সত্য। এ কাজের জন্য তারা ১৯৫৮ সালে নোবেল প্রাইজও পেয়ে গেলেন।


উপেক্ষিত ডিএনএ'র জীন-গবেষণায় অন্তর্ভূক্তি


আজকাল বিজ্ঞান সম্বন্ধে সামান্য ধারণা আছে, কিন্তু ডিএনএ'র নাম শোনেনি এমন লোক পাওয়া বোধ হয় দুষ্কর। বেশিরভাগই হয়তো এ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না, তবে "ডিএনএ টেস্ট করলেই সব জানা যাবে!" এ ধরনের জ্ঞানগর্ভ উক্তিদাতার খুব একটা অভাব দেখা যায় না! এই ডিএনএ ১৮৬৯ সালে আবিষ্কৃত হলেও জীন গবেষণায় উপেক্ষিত ছিল প্রায় ৭৫ বছর। কেন এই উপেক্ষা? দাঁড়ান, বলছি। শ্বেত রক্তকণিকার নিউক্লিয়াস থেকে ফ্রেডরিক মিশার এক ধরনের বস্তু আলাদা করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন নিউক্লিন। পরবর্তীতে এর নাম হয় ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ। বিংশ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা জানলেন যে, ডিএনএ আসলে একটা অনেক বড়সড় অণু, যা তৈরি চিনি, ফসফেট এবং অ্যাডেনিন (সংক্ষেপে A), থাইমিন (T), গুয়ানিন (G) আর সাইটোসিন (C) নামক চার ধরনের ক্ষার দিয়ে। A,T,G,C এই চার ধরনের ক্ষারের ভিন্ন ধরনের সন্নিবেশের কারণেই একেকটা ডিএনএর স্বাতন্ত্র। বিজ্ঞানীরা একটু ভুল করলেন এই সন্নিবেশ ধরতে। তারা শুরুতে অন্যান্য পলিমার অণুর মতো বিবেচনা করলেন, যেখানে একই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমন ACTGAACTGAACTGA - তে ACTGA প্যাটার্নটি আছে ৩ বার। একই প্যাটার্নের অতি সাধারণ পুনরাবৃত্তিসম্পন্ন ডিএনএ এত বৈচিত্রময় জীবনবৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারে না - এই ভেবে বিজ্ঞানীরা নজরই দিলেন না এই মহাগুরুত্বপূর্ণ অণুটির উপর। অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো ১৯৪৪ সালে অসওয়াল্ড অ্যাভেরি এবং তার দুই সহকর্মী ম্যাকলিউড আর ম্যাককার্টি প্রমাণ করলেন যে, ডিএনএর ভিতরেই জীনের অবস্থান!

অ্যাভেরিদের পরীক্ষাটাও মজার। তারা ব্যাক্টেরিয়া থেকে বিভিন্ন জৈব পদার্থ সরিয়ে ফেলার কৌশল ব্যবহার করলেন তাদের পরীক্ষায়। Streptococcus pneumoniae নামের এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া আছে। নামের ২য় অংশ দেখেই আশা করছি বুঝতে পারছেন যে, এটি নিউমোনিয়ার অন্যতম কারণ। এই ব্যাক্টেরিয়ার ২টা রূপ আছে - মসৃণ আর অমসৃণ, নিচের ছবির মতো।

চিত্র ১: মসৃণ ও অমসৃণ S. pneumoniae কোষ
Dr. Harriet Ephrussi-Taylor এর গবেষণার ছবি, সৌজন্যে: The Rockefeller University
 অমসৃণ থেকে মসৃণ রূপে রূপান্তর হলেই রোগ দেখা দেয়। অ্যাভেরিদের আগে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে, জীন আছে প্রোটিনের ভিতর। তাই তারা শুরুতে এই ব্যাক্টেরিয়া থেকে প্রোটিয়েজ ব্যবহার করে সকল প্রোটিন ধ্বংস করে ফেললেন। কিন্তু তাতে রোগ সারলো না, অর্থাৎ অমসৃণ থেকে মসৃণ রূপে রূপান্তর চলতেই থাকলো। তার মানে, অমসৃণ থেকে মসৃণে রূপান্তরের জন্য যে তথ্য দরকার, তা প্রোটিনের ভিতরে থাকে না, থাকলে তো প্রোটিন ধ্বংসের সাথে সাথে এই রূপান্তর বন্ধ হয়ে যেত। এরপর তারা ডিএনএ ধ্বংসকারী এনজাইম দিয়ে সকল ডিএনএ ধ্বংস করে ফেললেন। এবং তাতে রোগ সেরে গেল। এতে প্রমাণ হয়ে গেল যে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ডিএনএর ভিতরেই ছিল, যে কারণে ডিএনএ ধ্বংসের সাথে সাথে অমসৃণ থেকে মসৃণ কোষে রূপান্তর বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যভাবে বললে, জীন আছে ডিএনএর ভিতরেই।

তবে কেন যেন এত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পরেও এই তিন বিজ্ঞানীর কেউ নোবেল পুরস্কার পাননি। ব্যাপারটা একটু অবাক হওয়ার মতোই!


ডিএনএতেই জীনের অবস্থান - আরো এক প্রমাণ


কোন ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে তা নিয়ে যত পরীক্ষা করাই হোক না কেন, ফলাফল হবে সেই একই, তাই না? তবে আগের ভুল ধারণা মুছে দিতে হলে কেবল একটা পরীক্ষায় পাশ করলেই হয় না, বরং নানান ধরনের পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, এত সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় জোরালো ভাবে। জীন থাকে প্রোটিনের ভিতর - অনেক দিনের এ ধারণা মুছে দিতে হার্শেচেস এক পরীক্ষা করেছিলেন। এ পরীক্ষায় তারা ব্যবহার করেছিলেন ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া। কিছু ভাইরাস আছে যারা ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে, এদেরকে বলে ব্যাক্টেরিওফেজ বা সংক্ষেপে ফেজ। ফেজগুলো ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে এর ভিতর ঢুকে বংশবৃদ্ধি করে। ফেজ ভাইরাসের গঠন সহজভাবে বুঝাতে চাইলে বলতে হয়, এর খোলস অংশ (মাথা, কলার ও লেজের বাইরের অংশ) প্রোটিন দিয়ে তৈরি, আর মাথার ভিতরে থাকে ডিএনএ, নিচের ছবির মতো।

চিত্র ২: ব্যাক্টেরিওফেজের গঠন

হার্শে আর চেস করলেন কি, কিছু ফেজ ভাইরাসের প্রোটিনসহ খোলসকে তেজস্ক্রিয় সালফার (35S) দিয়ে চিহ্নিত করে দিলেন, যাতে প্রোটিনের চলাফেরা/গতিপথ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। একইভাবে কিছু ভাইরাসের ডিএনএকে তেজস্ক্রিয় ফসফরাস (32P) দিয়ে চিহ্নিত করে দিলেন। এরপর দেখতে লাগলেন ফেজগুলোর আক্রমণ প্রক্রিয়া।
চিত্র ৩: হার্শে ও চেসের পরীক্ষা

তারা দেখলেন যে, ফেজগুলো ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণের সময় ফেজের খোলস (প্রোটিন) অংশ ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে ঢুকেনি, কিন্তু ডিএনএ অংশ ভিতরে ঢুকেছে। এরপর দ্রতগতিতে নাড়িয়ে মিশ্রণ তৈরি করলেন যেন ব্যাক্টেরিয়ার গায়ের বাইরের দিকে লেগে থাকা খোলসগুলো গা থেকে খসে যায় এবং শেষমেশ খসে যাওয়া খোলস আলাদা করে ফেললেন। এতে বাইরের প্রোটিন আলাদা হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু ব্যাক্টেরিয়ার ভিতরে ঢুকে যাওয়া ফেজের ডিএনএ ব্যাক্টেরিয়ার ভিতরেই রয়ে গেল। কিন্তু এরপরেও দেখা গেল যে, ফেজ ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঠিকমতোই হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রোটিন না থাকার পরেও কেবল ডিএনএ থাকার ফলেই বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। তার মানে, বংশগতির বৈশিষ্ট্যগুলো প্রোটিন নয়, বরং ডিএনএতেই ছিলো; না হলে তো আর বংশবৃদ্ধি ঘটতো না।

এসব মজার মজার বুদ্ধিদীপ্ত গবেষণাগুলোর কারণেই জীবনের গল্প আজ এত সমৃদ্ধ! তবে, গল্পের কাহিনী যে আরো কিছু বাকি রয়ে গেল, সে কারণে দুঃখিত।

রেফারেন্স:
১) Neil C. Jones and Pavel A. Pevzner, Introduction to Bioinformatics Algorithms
২) Stuart M. Brown, Essentials of Medical Genomics

Tuesday, July 31, 2012

উদ্দেশ্যহীন জীবন, দ্বিধান্বিত মন

কেউ আমাকে একটু কষ্ট করে বোঝাবেন, জীবনের উদ্দেশ্য কি? সত্যি বলছি, এই ব্যাপারে বিশেষ অজ্ঞ আমি। বিশেষ সন্দিহান। ছোটবেলায় না হয় শুনেছিলাম - স্বর্গ-নরক আছে, স্বর্গে যেতে হলে তাই ভাল কাজ করতে হবে। ধর্মের কথা থাক। ধর্ম যখন ছেড়েছি, তখন না হয় স্বর্গ-নরকের কথাও বাদ দিলাম। কিন্তু ছোটবেলার আরেকটা শিক্ষার কথা এখনো ছাড়তে পারিনি। কেন পারিনি তাও জানিনা। কিছু জিনিসকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেতে কি? জানি না। তবে কথাটা মনে মনে মানি - "মানুষ বাঁচে কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়"। কিন্তু যখনই এ কথার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে যাই, বেয়াড়া মন তখন বলে, জীবনেরইতো কোন অর্থ নেই, আর দশটা প্রাণীর মতো আমিও একদিন মরে যাবো। বিজ্ঞান বলে, আমারতো নয়ই, বিশেষত্ব নেই কারো মাঝেই। এ অবস্থায় "কর্মের মধ্যে বাঁচা"-র মতো দার্শনিক অবস্থানের গুরুত্ব কোথায়? আমরা কি নিজেরা বেঁচে থাকার অর্থ বের করার জন্য শুধু-শুধুই কিছু অর্থহীন অর্থ দাঁড় করাচ্ছি না?

তবে একটা সত্য ক্ষণে-ক্ষণে উপলব্ধি করি, মহৎ কাজ করলে অন্যের সম্মান পাওয়া যায়, সম্মান পেতে ভাল লাগে। ভাল কাজ করলে অন্যের বাহবা পাওয়া যায়, বাহবা পেতে ভাল লাগে। আমি চাই অন্য কেউ আমার কাজের প্রশংসা করুক, প্রশংসা পেতে ভাল লাগে। ভাল লাগে অন্যরা আমার কাজের প্রতি সমর্থন জানালে; ভাল লাগে আমার প্রতি, আমার কাজের প্রতি অন্যদের আকর্ষণ দেখলে।

এই ভাল-লাগা-গুলোর মাঝে কেমন যেন একটা শো-অফ টেন্ডেন্সি আছে, তাই না? নিজে যা করি, তা অন্যদের দেখানোর ব্যাপার আছে, তাই না? এই "শো-অফ" জিনিসটাকে আবার বিশেষ অপছন্দ। তাই নিজেকে সেই শো-অফের তালিকায় দেখলে খারাপ লাগে। চোখের সামনে দেখতে পাই - প্রায় প্রতিটা মানুষ নিজেকে বিজ্ঞাপন বানিয়ে প্রচার করছে। এক শিক্ষককে যেকোন কথার শুরুতেই তাই বলতে শুনি - "When I was in Japan, ..."। মেইলের শেষে তাই দেখতে পাই - "Sent from my iPhone"। কিংবা কারো সাথে গল্প করতে গেলেই শুনতে পাই - "আমার বেলায় কি হয়েছে জানো ..."। মুক্তমনাতেও দেখতে পাই - "এ নিয়ে আমিও একটা লেখা লিখেছিলাম, এই যে লিংক ..."। আমি নিশ্চিত এ ধরনের শো-অফকে অপছন্দ করেন সবাই, বিশেষ করে অন্যের বেলায় হলেতো অবশ্যই। সমস্যা কেবল নিজের বেলায় এ তত্ত্ব প্রয়োগের ব্যাপারে। সকলেই বলবেন, "আমিতো করিনা।" নিজেকে এ সমস্যার বাইরের কেউ বলে দাবি করছি না, তবে অন্যদের এ ধরনের আচরণ দেখে মনে মনে ঠিকই হাসি। :) আর নিজের জন্য মনে মনে একটা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করি - "আমি আমার কাজ করে যাই, এতে যদি কেউ ভাল বলে তো বলুক, প্রশংসা করে তো করুক, সেদিকে মাথা না ঘামাই।"

কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে কী হয়, বলুন। না হয় নিজের কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করলাম না, কিন্তু আমিতো ঠিকই জানি, একটুখানি সম্মানের জন্য কীরকম মুখিয়ে থাকে মন! একটুখানি প্রশংসা কীরকম উৎসাহিত করতে পারে আমায়! আচ্ছা, এই কারণে কি আমাকে ভন্ড বলা যেতে পারে? সততার সাথে বলি - আমার মনে হয় আমাকে ভন্ড বলা যেতেই পারে। এরপর মন ফিরে যায় আগের জায়গায়, এবার দেয় ভিন্ন যুক্তি - কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকার মানে কি? পরবর্তীতে কেউ সম্মানের সাথে বলবে, 'অমুকে' তমুক কাজ করছিলো - এইতো? তাহলে আমি যদি সেইভাবে বাঁচতে চাই, আমি যদি আমার কাজের জন্য অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা প্রত্যাশা করি, তাহলে আমাকে ভন্ড বলা হবে কেন? একটু পরেই যুক্তি-তর্ককে বিদায় করে দেয় মন। তার কাছে একটা প্রবোধ তৈরিই থাকে - "হলাম না হয় ভন্ড, এরকম ভন্ড সবাই, কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না।"

আচ্ছা, ভন্ড হলেই বা ক্ষতি কি? জীবনের কি কোন অর্থ আছে? কোন উদ্দেশ্য আছে? মনের মধ্যে বাজতে থাকে "Shall We Dance?" সিনেমার "মানুষ কেন বিয়ে করে?" প্রশ্নটার উত্তর, যার মধ্যে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু সত্য আছে কিনা তাই ভাবি -


Because we need a witness to our lives. There's a billion of people on the planet. What does any one life really mean? But in a marriage, you are promising to care about everything - the good things, the bad things, the terrible things, the mundane things... all of it, all the time, every day. You're saying "Your life will not go unnoticed, because I'll notice it. Your life will not go unwitnessed, because I'll be your witness."

Thursday, April 19, 2012

এলোমেলো-০৮

তাদেরই কাজের সমালোচনা হয়, যারা কিছু হলেও কাজ করেছে, যারা কিছুই করেনি তাদের নয়।

Friday, April 13, 2012

প্রবাস

এখানে কাক নেই
"কা-কা"ও নেই
কাকেদের সঙ্গী হয়েছে পহেলা বৈশাখ!

Sunday, March 4, 2012

বোকা কম্পিউটারের চালাকি – ৪ : “আয়োডিন সমস্যা”

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই লেখা কম্পিউটারবোদ্ধাদের জন্য নহে।


আচ্ছা, আমি যে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুন্দরী মেয়ে দেখতে গেলে কিংবা সুন্দরী মেয়ে দেখতে দেখতে রাস্তায় হাঁটতে গেলে প্রায়ই হোঁচট খাই, তা কি কেউ আপনাদের বলে দিয়েছে? এই আমার এক দোষ। একসাথে দুইটা কাজ ঠিকমতো করতে পারি না। সুন্দরী দেখা আর রাস্তায় হাঁটা – দুইটাতো আলাদা কাজ, তাই না? দুইটা কাজ কি একসাথে ঠিকভাবে করা যায় বলেন? অন্যরা পারলেও পারতে পারে, তবে ভাই, আমি পারি না। আমার এক বন্ধু একে কী বলে জানেন? বলে, “আয়োডিনের অভাব”।

জানলে হয়তো অবাক হবেন, কেবল আমার না, কম্পিউটারের মধ্যেও “আয়োডিনের অভাব” আছে। ভাবছেন কী বলতে চাচ্ছি? ঐ যে, আরে ঐ যে, কম্পিউটারের সব কাজ করে যে প্রসেসর, ঐরকম একটা বেসিক প্রসেসর একসাথে একটার বেশি কাজ করতে পারে না। একটার বেশি প্রোগ্রাম চালাতে পারে না। আমার মেয়ে দেখা আর রাস্তায় হাঁটা যদি “আয়োডিনের অভাব” হতে পারে, কম্পিউটারের এই বৈশিষ্ট্যও কি তবে তাই না? আপনি হয়তো এর মধ্যেই চিন্তা করা শুরু করছেন যে, “আমিতো দিব্যি ৮-১০ টা প্রোগ্রাম চালাই একসাথে”, তাই না? নিচের ছবিটাকে হয়তো প্রমাণ হিসেবেও দেখাতে চাইবেন।

একসাথে চলছে অনেকগুলো প্রোগ্রাম
একসাথে চলছে অনেকগুলো প্রোগ্রাম

আপনার মনে আছে কি – ০ আর ১ দিয়ে গড়া ইন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রোগ্রাম কীভাবে কাজ করে? প্রতিটা প্রোগ্রামের (মাইক্রোসফ্‌ট্‌ ওয়ার্ড, মজিলা ফায়ারফক্স, মেসেঞ্জার ইত্যাদি) চলার পিছনে এক সেট ইন্সট্রাকশন থাকে। মাইক্রোসফ্‌ট ওয়ার্ড যখন চলে তখন আসলে তার ইন্সট্রাকশন একটার পর একটা চলতে থাকে, আবার যখন ফায়ারফক্স চলে তখন আসলে তার ইন্সট্রাকশন চলতে থাকে। একটা প্রোগ্রাম চালাতে হলে সেই প্রোগ্রামের ইন্সট্রাকশনগুলো প্রথমে মেমোরিতে নিতে হয়। মেমোরিতে নেয়া ইন্সট্রাকশনগুলো চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডাটা সেভ করা থাকে কিছু রেজিস্টারে। এই প্রয়োজনীয় ডাটা কিরকম হতে পারে তার উদাহরণ দিচ্ছি - মেমোরির কোন্‌ জায়গা থেকে ইন্সট্রাকশন শুরু হয়েছে, এই মুহুর্তে কোন্‌ ইন্সট্রাকশন চলছে, যদি এই ইন্সট্রাকশনটা ‘যোগ’ হয় তবে কোন্‌ কোন্‌ সংখ্যা যোগ করা হচ্ছে আর যোগফলই বা কোথায় সেভ করা হবে, এর পরের ইন্সট্রাকশনটা কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কথা বলছিলাম, এই রেজিস্টারও এক ধরনের মেমোরি, তবে একটু বিশেষ ধরনের, আমরা র‍্যাম (RAM - Random Access Memory) বলে যা জানি তা থেকে ভিন্ন। রেজিস্টারে ডাটা সেভ করে রাখা যায় খুব দ্রুত, আবার খুব দ্রুত এখান থেকে ডাটা পড়ে নেয়াও যায়। এই দ্রুততার কারণেই মূলতঃ প্রসেসর (অন্য কথায় কম্পিউটার) এত দ্রুত কাজ করতে পারে। তবে এই দ্রুততা পাওয়ার জন্য একেকটা রেজিস্টারকে একেকটা বিশেষ কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করতে হয়। সেই সাথে রেজিস্টারের সংখ্যাও রাখতে হয় খুব সীমিত, না হলে কখন কোন্‌ রেজিস্টার থেকে ডাটা আনা-নেয়া করতে হবে সেটা বের করতেই সময় চলে যাবে। কম্পিউটারের সব কয়টা প্রোগ্রামকেই তাই একই রেজিস্টার ব্যবহার করতে হয়।

কিছু মনে করবেন না, একটা দুর্গন্ধময় উদাহরণের কথা মাথায় এসেছে। আপনার বাসায় যে পায়খানা আছে, সেটা মল-মূত্র ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি, তাই না? নিশ্চয় খাওয়া-দাওয়া-ঘুমের জন্য তৈরি না। :P  আর এটা ব্যবহার করার জন্য – আপনার পরিবারের একেকজন যার যখন দরকার হয় তখন পায়াখানায় গিয়ে শান্তির কর্মটি সেরে আসেন, তাই না? বেয়াদবি মাফ করবেন, রেজিস্টারও একরকম পায়খানার মতো, এটি বিশেষ কাজের জন্য তৈরি এবং যখন সে প্রোগ্রামের দরকার হয় সেই প্রোগ্রাম রেজিস্টার ব্যবহার করে আসে। আপনারা যেমন দুইজন একসাথে সেই পায়খানা ব্যবহার করতে যান না, তেমনি একাধিক প্রোগ্রামও একইসাথে সেই রেজিস্টার ব্যবহার করতে পারে না। তাই একটা প্রসেসরে আসলে একই সময়ে একটার বেশি প্রোগ্রাম চলতে পারে না। আরো সঠিকভাবে বললে, প্রসেসরে একই সময়ে একটা ইন্সট্রাকশনের বেশি চলতে পারে না। “আয়োডিনের সমস্যা”-র মূল বিষয়টাই এখানে।

আপনি নিশ্চয় এখনো চিন্তা করছেন – “আমি তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, কম্পিউটার একসাথে বহু প্রোগ্রাম চালাচ্ছে, এমন একটা উদাহরণ উপরে দিয়েছিও ছবির মাধ্যমে, তাহলে আয়োডিন সমস্যা থাকলো কোথায়?”। একটু দাঁড়ান, উত্তর দিচ্ছি। তার আগে মাইক্রোসফ্‌ট্‌ ওয়ার্ডে (অথবা ওপেন অফিস কিংবা অন্য কোন টেক্সট এডিটরে) লেখালেখির কথা একটু ভাবুনতো। আমিই যখন ওয়ার্ডে এই লেখাখানি লিখছি, তখন একটা লাইন লিখে আবার চিন্তা করছি পরের লাইনটা কীভাবে লিখলে আপনাকে সহজে আমার কথা বুঝাতে পারবো। চিন্তা করছি – আগের লাইনটা ঠিক হয়েছে তো? আমি যখন এইসব চিন্তা করছি, কিছুই লিখছি না, তখনতো আসলে মাইক্রোসফ্‌ট্‌ ওয়ার্ডের কোন কাজ করতে হচ্ছে না, মনিটরে প্রোগ্রামটা দেখা যাচ্ছে কেবল। এইসময় মনিটর আমার প্রোগ্রামের জন্য ব্যস্ত থাকলেও সেই রেজিস্টারগুলো কিন্তু এক্কেবারেই বেকার বসে আছে। এত এক্সপার্ট রেজিস্টারগুলোকে বসিয়ে রাখার কোন দরকার আছে বলুন? তার চেয়ে এই বেকার সময়টাতে অন্য কোন প্রোগ্রাম চালানো গেলে ভাল হতো না? ধরুন, হয়তো ইউটিউব থেকে ডাউনলোড চলতে থাকলো এই সময়ে, তাহলে ভাল হতো না? হ্যাঁ, কম্পিউটার আসলে এই কাজটাই করে। কিছু সময় একটা প্রোগ্রাম চালিয়ে আবার অন্য আরেকটা প্রোগ্রাম চালাতে যায়। আর এই ব্যাপারটাকে বলে টাস্ক-সুইচিং বা কনটেক্সট সুইচিং। টাস্ক সুইচিংয়েরর সময় অর্থাৎ এক প্রোগ্রাম থেকে অন্য প্রোগ্রামে যাওয়ার সময়, কম্পিউটার প্রথমে এখন যে প্রোগ্রামটা চলছে সেই প্রোগ্রামের জন্য রেজিস্টারে রাখা সব ডাটা মেমোরিতে সেভ করে, তারপর অন্য প্রোগ্রামটা চালিয়ে দেয়। আবার আগের প্রোগ্রামে ফিরে আসার সময় মেমোরিতে সেভ করে রাখা ডাটা আগে রেজিস্টারে রাখে, ও পরে সেই প্রোগ্রামটা চালিয়ে দেয়। এভাবে এক প্রোগ্রাম থেকে অন্য প্রোগ্রামে যাওয়া আসার কাজটা এত দ্রুত ঘটে যে, আপনি টেরই পাননা - আপনি যখন কোন একটা প্রোগ্রামে কাজ করছেন, কম্পিউটার তখন আপনার প্রোগ্রাম ছেড়ে অন্য প্রোগ্রাম থেকে ঘুরে আসছে! এভাবেই আসে কম্পিউটারের একসাথে একাধিক কাজ করার ক্ষমতা, যাকে বলে মাল্টিটাস্কিং

একজন প্রোগ্রামার যখন একটা প্রোগ্রাম তৈরি করেন, তখনতো আর তিনি জানেন না যে, ঐসময়ে আর কোন্‌ কোন্‌ প্রোগ্রাম চলবে। এক প্রোগ্রাম থেকে অন্য প্রোগ্রামে সুইচিংযের কাজটা করে কে তাহলে? এটা করে থাকে আমাদের অপারেটিং সিস্টেম (যেমনঃ উইন্ডোজ, লিনাক্স)। অপারেটিং সিস্টেমের কাছে কখন কোন্‌ প্রোগ্রাম চলছে সব তথ্য থাকে। সে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও থ্রেড (থ্রেড কী জিনিস একটু পর বলছি) এর মাঝে রেজিস্টারসহ কম্পিউটারের বিভিন্ন রিসোর্স কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা ঠিক করে দেয়। কেতাবি ভাষায় একে বলে টাস্ক শিডিউলিং। এই শিডিউলিংটা প্রতিটা টাস্ক ১ মিলিসেকেন্ড পরপর চালিয়ে দেয়ার মতো সাধারণ হতে পারে (যাকে বলে রাউন্ড-রবিন শিডিউলিং), আবার আপনার স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী বুদ্ধিদীপ্তও হতে পারে।  যেমন ধরুন, আপনি নিশ্চয় চাইবেন আপনার দরকারি ও প্রিয় প্রোগ্রামগুলো যেন দ্রুত কাজ করে, কোনভাবে যেন বাঁধাগ্রস্ত না হয়। অর্থাৎ, প্রোগ্রামগুলো যেন অগ্রাধিকার (বা প্রায়োরিটি) অনুযায়ী শিডিউলিং করা হয় (যাকে বলে প্রায়োরিটি-বেস্‌ড শিডিউলিং) আবার গান শুনার সময় আপনি নিশ্চয় ভেঙ্গে-ভেঙ্গে আসা সুর পছন্দ করবেন না; নিশ্চিত করতে চাইবেন যে, গান শুনার সময়, বাবা কম্পিউটার, তুমি যে কাজই কর না কেন প্রতি ০.১ সেকেন্ডের মধ্যে গান শোনানোর প্রোগ্রামে ফিরে এসো, যাতে শব্দ শুনা যায় ঠিকভাবে। এভাবে নানান দিক বিবেচনা করে অনেকগুলো টাস্ক বা প্রোগ্রামের মধ্যে সমন্বয় করা হয়।

থ্রেডের ব্যাপারটা বলি এখন। একটা প্রোগ্রাম ফ্রী থাকলে সেই ফ্রী-টাইমের সদ্ব্যবহার করতে যেমন অন্য প্রোগ্রাম চালানো যেতে পারে, ঠিক তেমনি ঐ সময়ে ঐ একই প্রোগ্রামের অন্য কাজও করা যেতে পারে। একই প্রোগ্রামের মধ্যে যখন এই বুদ্ধি খাটানো হয়, তখনই আসে থ্রেডিং এর ব্যাপার-স্যাপার। একটা প্রোগ্রামে অন্তত একটা থ্রেড থাকে, একাধিক থ্রেডও থাকতে পারে। যেমন ধরুনঃ মিউজিক ভিডিও। এখানে গান শোনা আর ভিডিও দেখা - এই দুইটা আলাদা কাজ। তাই প্রোগ্রামের একটা অংশ গান শোনাতে পারে, আরেকটা অংশ আলাদাভাবে ভিডিও দেখাতে পারে। অর্থাৎ এখানে দুইটা থ্রেড থাকতে পারে, যদিও এই দুইটা থ্রেডের মধ্যে সমন্বয়ের দরকার আছে। আপাতদৃষ্টিতে বেশ সহজ একটা ধারণা হলেও, থ্রেডিং ব্যাপারটা প্রোগ্রামিংয়ের দিক থেকে একটু জটিল, তাই বেশির ভাগ প্রোগ্রামারই সাধারণত যতক্ষণ এক্কেবারে না হলেই নয় ততক্ষণ থ্রেডিং ব্যবহার করেন না।

যাই হোক, আবার ফিরে আসি আগের উদাহরণের দিকে। পিক-টাইমে কেন একজন তীর্থস্থানে (মানে পায়খানায়) বেশি সময় নিচ্ছে এ নিয়ে নিশ্চয় কোন-না-কোন দিন অভিযোগ করেছেন, করেননি? তখন নিশ্চয় মনে হয়েছে, আরেকটা পায়খানা থাকলে ভাল হতো, তাই না? কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও হয়তো এখন আপনার মনে হচ্ছে, আরেক সেট রেজিস্টার থাকলেই হতো। কি, মনে হচ্ছে কি? আপনি জিনিয়াস, আসলেই আরেক সেট রেজিস্টার থাকলে ভাল হতো। তবে, আমিতো সহজভাবে বলার খাতিরে কেবল রেজিস্টারের কথা বলেছি, এগুলোর সাথে মেমোরি-থ্রেডিং-শিডিউলিং সহ আরো বেশ কিছু জিনিস সম্পর্কিত, সেই জিনিসগুলোকেও ঠিকমতো কাজ করতে হবে। আপনি হয়তো এর মধ্যে ডুয়াল-কোর, কোর-টু-ডুয়ো, কোয়াড-কোর, কোর-আই-৩, কোর-আই-৫, কোর-আই-৯ এইসব প্রসেসরের কথা শুনেছেন। এরকম প্রসেসর হল মাল্টি-কোর প্রসেসর, যেখানে আসলে একাধিক প্রসেসর (বা “কোর”) একসাথে একটা প্রসেসরের মতো কাজ করে।

তবে, বাসায় একাধিক তীর্থস্থান (পায়খানা) থাকলেও সবাই যদি একটাতেই যায়, তাহলে যেমন কোন লাভ নেই, তেমনি কম্পিউটারে একাধিক কোরের প্রসেসর থাকলেও সব প্রোগ্রাম যদি একই কোরে চালানো হয়, তাতেও কোন লাভ নেই। এই মাল্টি-কোরের সুবিধা নিতে হলে টাস্ক-শিডিউলিং হতে হবে বুদ্ধিদীপ্ত। সৌভাগ্যক্রমে, এখনকার অপারেটিংসিস্টেমগুলো এই কাজটা ভালভাবেই করে। তারপরেও কিছু কিন্তু থেকে যায়। ধরুন, আপনার কোয়াড-কোর প্রসেসর আছে, মানে ৪টা কোর আছে আপনার প্রসেসরে। কিন্তু, আপনি প্রোগ্রাম চালাচ্ছেন এই মুহুর্তে মাত্র ২টা। আপনার অপারেটিং সিস্টেম ২টা প্রোগ্রাম ২টা ২ কোরে চালিয়ে দেবে। বাকি ২টা কিন্তু এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেল। ঐগুলোকে যদি আপনার প্রোগ্রাম ২টা ব্যবহার করতে পারতো, তাহলে ভাল হতো না? এটাও আসলে সম্ভব। তবে, সেজন্য প্রোগ্রামগুলোকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে থ্রেডিংয়ের ব্যবহার করতে হবে। তবে, ঐ যে আগে বলেছিলাম, থ্রেডিং একটুখানি জটিল বলে প্রোগ্রামাররা সাধারণত এড়িয়ে যান। আজকের দিনের বেশিরভাগ প্রোগ্রামেই একটা মাত্র থ্রেড থাকে বলে মাল্টি-কোরের পুরো সুবিধাটুকু নেয়া সম্ভব হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। এটা সমাধানের জন্য প্রোগ্রামিং মডেলে পরিবর্তন আনা বিষয়ক গবেষণা চলছে, একই প্রোগ্রামে কিভাবে অনেকগুলো কাজ একসাথে করা যায় তা নিয়ে গবেষণা চলছে, যাকে বলে প্যারালেল প্রোগ্রামিং। আশা করা যায়, নিকট ভবিষ্যতে প্রোগ্রামগুলোও হবে চালাক-চতুর, “আয়োডিন সমস্যা” চলে যাবে চিরতরে।

Saturday, January 7, 2012

পূর্বজন্ম নয়, জন্ম-পূর্বের কথা

কথাটা শুনে চোখ বড়-বড় করে তাকালাম, কান দু’খানি খাড়া করে শুনলাম। বলে কি! আমি নাকি জন্মের আগে থেকেই আমার মায়ের কন্ঠস্বর চিনি! না, না, এই গুণখানি স্বপ্নে প্রাপ্ত হইনি আমি। চুপে চুপে বলি, আপনি নিজেও ছিলেন এ ব্যাপারে পারদর্শী। আসলে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য খুঁজে বের করেছেন। সত্যি, বিজ্ঞানী-গবেষকরা আজিব প্রাণী, আজিব তাদের পরীক্ষার ধরণ। তারা কী করেছে জানেন, নবজাতক বাচ্চাদের তাদের মায়ের কন্ঠস্বরের রেকর্ড বাজিয়ে দিয়ে আর মুখে একখান রাবারের নিপল গুঁজে দিয়ে চুষতে দিয়েছে, এই কাজটা তারা ভাল পারে। একই কাজ করেছে অচেনা মহিলার কন্ঠস্বরের রেকর্ড বাজিয়ে দিয়ে। দেখা গেছে – মায়ের কন্ঠস্বরের রেকর্ড শুনলে বাচ্চাদের নিপল চুষার গতি কম থাকে। নিশ্চয় এখন বলবেন, তাতে কি হয়েছে? হয়েছে অনেক কিছুই। কারণ এর আগে আজিব গবেষকরাই খুঁজে বের করেছেন, বোরিং লাগলে বাচ্চারা চুষার গতি বাড়িয়ে দেয়। বাচ্চারা তার মায়ের কন্ঠস্বর চিনতে পারে এবং তা শুনতে পছন্দ করে বলেই তখন নিপল চুষতে ততখানি আগ্রহ বোধ করে না।

বাচ্চারা তাহলে মায়ের কন্ঠ চিনলো কিভাবে? চারপাশের শব্দতরঙ্গগুলো মায়ের পেটের মাংসপেশীর মধ্য দিয়ে বাচ্চারা যে তরলের মধ্যে থাকে (অ্যামনিয়টিক ফ্লুয়িড) তার ভিতর দিয়ে যায়। ফলে বাচ্চারাও শব্দ শুনতে পায়। আর মায়ের কন্ঠই বেশি শুনে বলে তারা তা চিনতে পারে। ধরুন, আপনার মা যদি আপনাকে গর্ভে ধারণের সমইয়ে নিয়মিত বিটিভির ৮টার বাংলা সংবাদ শুনে থাকে, তাহলে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটার সুর হয়তো আপনার জন্মের আগে থেকেই চেনা! আজিব বিজ্ঞানীরা এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টও করছে। তারা আরো কী বলে জানেন? জন্মের পরপরই বাচ্চারা যে কান্নাকাটি করে, সেটাও নাকি নিজ মাতৃভাষায়! কান্নারও নাকি ভাষা হয়, সেটাও নাকি তারা জন্মের আগেই শিখে! ফরাসি বাচ্চারা নাকি উর্ধ্বগামী সুরে কাঁদে, আর জার্মানরা নাকি নিম্নগামী সুরে কাঁদে। উর্ধ্বগামিতা-নিম্নগামিতা নাকি তাদের মাতৃভাষার বৈশিষ্ট্য। কালে কালে যে কত কী শুনবো! 

গর্ভাবস্থায় বাচ্চারা যে কেবল শব্দ/ভাষা চিনতে শিখে তা নয়, গন্ধ আর স্বাদও তারা ঐসময় থেকেই শিখতে শুরু করে। গর্ভধারণের ৭ম মাসে বাচ্চাদের অলফ্যাক্টরী নার্ভ বিকশিত হয়, যার মাধ্যমে আমরা গন্ধ-সম্বন্ধীয় অনুভূতি বুঝতে পারি। গবেষকরা কী করেছে শুনেন। কিছু কিছু গর্ভবতী মা কে গর্ভধারণের ৭ম মাসে গাজরের জুস খেতে দিয়েছে। এতে হয়েছে কী... বাচ্চার চারপাশের অ্যামনিয়টিক ফ্লুয়িডে গাজরের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাচ্চারা তখন থেকে ঐ গন্ধ পছন্দ করেছে। জন্মের ৬ মাস পরে যখন তাদের গাজরের জুস খেতে দেয়া হল, তখন তারা বেশ তৃপ্তি করে পরিমাণে অনেকখানি খেয়ে ফেলল। অন্যদিকে, সেইসব বাচ্চারা, যাদের মাকে গর্ভধারণের সময়টাতে গাজরের জুস খেতে দেয়া হয়নি, তারা মোটামুটি ‘ইয়াক্‌’ বলে ফেলে দিল।

এইসব গল্প শুনে আপনি হয়তো আপনার বাচ্চার জম্নের ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন। যদি বাচ্চাকে রবীন্দ্র সংগীতে আগ্রহী করতে চান কিংবা গায়ক বানাতে চান, তাহলে গর্ভে থাকাকালীন সময়ে নিয়মিত ভালো ভালো গান শুনাতে পারেন। কিংবা ক্রিকেটার বানাতে চাইলে নিয়মিত দেখতে থাকুন উত্তেজনাকর ম্যাচগুলো। পরিবারের মাঝে বৌ-শাশুড়ি-ননদের জিলাপির প্যাঁচওয়ালা, একে অপরের পিছনে কুটনামি করা সিরিয়ালগুলি দেখবেন না দয়া করে।

তবে ব্যাপার কী জানেন, কেবল শব্দ-গন্ধ-স্বাদ নয়, গর্ভকালীন সময় পুরোটাই নবাগতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটা বিষয়ের বিশেষ তাৎপর্য আছে তার জন্য। গর্ভে থাকা অবস্থায় বাচ্চারা তার আশেপাশের পরিবেশের প্রত্যেকটাকে তথ্যের উৎস হিসাবে দেখে। তাই একে বলা যেতে পারে ‘বায়োলজিক্যাল পোস্টকার্ড’। ধারণা করা হয়, গর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের খাদ্যাভ্যাস, স্ট্রেস-লেভেল, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা এসব দেখে নবজাতক বাইরের দুনিয়ায় কি কি ঝামেলায় পড়তে পারে সে বিষয়ে ধারণা লাভ করে ও নিজেকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করে। হল্যান্ডে ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যেসব শিশু মায়ের পেটে ছিলো তাদের মাঝে এক গবেষণা চালানো হয়েছে। ঐসব শিশুদের অনেকের মাঝেই জন্মের পরপরই পুষ্টিস্বল্পতাসহ নানান রকম প্রসব-পরবর্তী সমস্যা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে অনেক সমস্যা বহুদিন পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। দেখা গেছে, ঐ সময়ে জন্ম নেয়া মানুষদের মাঝে পরবর্তিতে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। ধারণা করা হয়, জন্ম পূরবর্তী অভিজ্ঞতার কারণে তাদের দেহ নানান রকম পরিবর্তন এসেছে। যেমনঃ গ্লুকোজ হজম করার ক্ষমতা এদের কম, যেটা ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। তখন মায়ের শরীরের ব্লাড প্রেসারও ছিলো কম, যেকারণে পরবর্তী জীবনে এদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা গেছে।

যারা জেনেটিক্স নিয়ে কিছু জ্ঞান রাখেন, তারা হয়তো এতক্ষণে ভেবে থাকবেন যে, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো যত না গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল, তারও চেয়ে বেশি জেনেটিক; ডিএনএ প্রোফাইল মূলতঃ এসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। জেনেটিক প্রভাবের কথা অগ্রাহ্য না করেও গবেষকরা আসলে দেখাতে চেয়েছেন যে, গর্ভাবস্থাকালীন পরিবেশ মানুষের পরবর্তী জীবনের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, অনেক ক্ষেত্রে ডিএনএ এর প্রভাবও ছাপিয়ে যায়। দেখা গেছে, মোটা মায়ের সন্তানেরা সাধারণত মোটা হয়। গবেষকরা, মোটা মায়েদের মেদ-ভূড়ি কমানোর সার্জারির আগে ও পরে গর্ভধারণ করা সন্তানদের মধ্যে তুলনামূলক গবেষণা চালিয়েছেন। যেহেতু একই মায়ের সন্তান তারা, কাছাকাছি জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং খাদ্যাভ্যাসও একই রকম হয় তাদের। তারপরেও দেখা গেছে, সার্জারির পরে জন্ম নেয়া শিশুদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা সার্জারির আগে জন্ম নেয়া তার বড় ভাই-বোনদের অর্ধেক, আর ভীষণ মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তিন ভাগের এক ভাগ। পরবর্তীতে জন্ম নেয়া শিশুদের জন্মপূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার কারণে এপিজেনেটিক প্রসেসের মাধ্যমে তাদের বিপাক-প্রক্রিয়া স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মত দেন। এছাড়া, গর্ভাকালীন সময়ে মায়েদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বায়ু দূষণ, পরিবেশ দূষণ সব বিভিন্ন কারণে নবজাতকের মাঝে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসার ব্যাপারটা এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত।

গর্ভকালীন সময়ের উপর এসব গবেষণা আশার আলো দেখাচ্ছে আমাদের। আমেরিকার অ্যারিজোনাতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হার দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি। সেখানকার মানুষ ডায়াবেটিসকে পারিবারিক রোগ হিসেবে নিয়তি হিসেবেই ধরে নিয়েছে। তবে, গবেষকরা আশা করছেন, যদি গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের গ্লুকোজ লেভেল ঠিক রাখা যায়, তাহলে হয়তো নবজাতকের বিপাক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকবে ও ডায়াবেটিসের হার কমবে।

গবেষকরা তাদের গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বছর বার আগে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে এক প্রজেক্ট শুরু হয় – ২০০০ এরও বেশি বাচ্চাদের জন্ম-পূর্ববর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ইতোমধ্যে অ্যাজমা, এলার্জি, মোটা হওয়া, হৃদরোগ সহ বিভিন্ন রোগের জন্মপূর্ববর্তী উৎস সম্বন্ধে এ প্রজেক্ট আলোকপাত করতে শুরু করেছে। গবেষণা চলছে গর্ভাবস্থায় মায়েদের খাদ্যাভ্যাস রোগ প্রতিরোধে কাজে আসে কি না তার উপর। ইদুরের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁধাকপি বা ব্রকলির মতো সবজি থেকে তৈরি করা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ গর্ভবতী ইদুরের দেহে প্রবেশ করালে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে। এছাড়াও, আমেরিকাতে বিশাল বাজেটের ন্যাশনাল চিলড্রেন’স স্টাডিতে ২ বছর আগে ২০১০ সালে ১ম এক লক্ষ গর্ভবতী নারী নাম লেখাতে শুরু করেছিলেন। তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, পরীক্ষা করা হয়েছে ও হচ্ছে তাদের চুল-লালা-রক্ত-মূত্র থেকে শুরু করে তাদের বাসার বাতাস-ধূলা-পানি। সন্তানগণ ২১ বছর হওয়া পর্যন্ত এই নারী ও তাদের সন্তানদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ বছর তাদের গবেষনার ১ম ফল বের হওয়ার কথা যাতে অপরিণত শিশু-জন্ম ও জন্মগত ত্রুটি বিষয়ক কথা থাকবে। দেখা যাক, কী বের হয়।

সব কথার শেষ কথা, গর্ভকালীন সময়টা নবজাতকের পরবর্তী জীবনটার আদল গড়ে দেয়। এ সময়ে তাই মায়েদের জন্য সর্বোচ্চ সুস্থ পরিবেশ (শারীরিক ও মানসিক উভয়ই) নিশ্চিত করা অতি জরুরি।

সূত্রঃ
১)http://www.ted.com/talks/annie_murphy_paul_what_we_learn_before_we_re_born.html
২)http://www.time.com/time/magazine/article/0,9171,2021065,00.html