কথাটা শুনে চোখ বড়-বড় করে তাকালাম, কান দু’খানি খাড়া করে শুনলাম। বলে কি! আমি নাকি জন্মের আগে থেকেই আমার মায়ের কন্ঠস্বর চিনি! না, না, এই গুণখানি স্বপ্নে প্রাপ্ত হইনি আমি। চুপে চুপে বলি, আপনি নিজেও ছিলেন এ ব্যাপারে পারদর্শী। আসলে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য খুঁজে বের করেছেন। সত্যি, বিজ্ঞানী-গবেষকরা আজিব প্রাণী, আজিব তাদের পরীক্ষার ধরণ। তারা কী করেছে জানেন, নবজাতক বাচ্চাদের তাদের মায়ের কন্ঠস্বরের রেকর্ড বাজিয়ে দিয়ে আর মুখে একখান রাবারের নিপল গুঁজে দিয়ে চুষতে দিয়েছে, এই কাজটা তারা ভাল পারে। একই কাজ করেছে অচেনা মহিলার কন্ঠস্বরের রেকর্ড বাজিয়ে দিয়ে। দেখা গেছে – মায়ের কন্ঠস্বরের রেকর্ড শুনলে বাচ্চাদের নিপল চুষার গতি কম থাকে। নিশ্চয় এখন বলবেন, তাতে কি হয়েছে? হয়েছে অনেক কিছুই। কারণ এর আগে আজিব গবেষকরাই খুঁজে বের করেছেন, বোরিং লাগলে বাচ্চারা চুষার গতি বাড়িয়ে দেয়। বাচ্চারা তার মায়ের কন্ঠস্বর চিনতে পারে এবং তা শুনতে পছন্দ করে বলেই তখন নিপল চুষতে ততখানি আগ্রহ বোধ করে না।
বাচ্চারা তাহলে মায়ের কন্ঠ চিনলো কিভাবে? চারপাশের শব্দতরঙ্গগুলো মায়ের পেটের মাংসপেশীর মধ্য দিয়ে বাচ্চারা যে তরলের মধ্যে থাকে (অ্যামনিয়টিক ফ্লুয়িড) তার ভিতর দিয়ে যায়। ফলে বাচ্চারাও শব্দ শুনতে পায়। আর মায়ের কন্ঠই বেশি শুনে বলে তারা তা চিনতে পারে। ধরুন, আপনার মা যদি আপনাকে গর্ভে ধারণের সমইয়ে নিয়মিত বিটিভির ৮টার বাংলা সংবাদ শুনে থাকে, তাহলে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটার সুর হয়তো আপনার জন্মের আগে থেকেই চেনা! আজিব বিজ্ঞানীরা এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টও করছে। তারা আরো কী বলে জানেন? জন্মের পরপরই বাচ্চারা যে কান্নাকাটি করে, সেটাও নাকি নিজ মাতৃভাষায়! কান্নারও নাকি ভাষা হয়, সেটাও নাকি তারা জন্মের আগেই শিখে! ফরাসি বাচ্চারা নাকি উর্ধ্বগামী সুরে কাঁদে, আর জার্মানরা নাকি নিম্নগামী সুরে কাঁদে। উর্ধ্বগামিতা-নিম্নগামিতা নাকি তাদের মাতৃভাষার বৈশিষ্ট্য। কালে কালে যে কত কী শুনবো!
গর্ভাবস্থায় বাচ্চারা যে কেবল শব্দ/ভাষা চিনতে শিখে তা নয়, গন্ধ আর স্বাদও তারা ঐসময় থেকেই শিখতে শুরু করে। গর্ভধারণের ৭ম মাসে বাচ্চাদের অলফ্যাক্টরী নার্ভ বিকশিত হয়, যার মাধ্যমে আমরা গন্ধ-সম্বন্ধীয় অনুভূতি বুঝতে পারি। গবেষকরা কী করেছে শুনেন। কিছু কিছু গর্ভবতী মা কে গর্ভধারণের ৭ম মাসে গাজরের জুস খেতে দিয়েছে। এতে হয়েছে কী... বাচ্চার চারপাশের অ্যামনিয়টিক ফ্লুয়িডে গাজরের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাচ্চারা তখন থেকে ঐ গন্ধ পছন্দ করেছে। জন্মের ৬ মাস পরে যখন তাদের গাজরের জুস খেতে দেয়া হল, তখন তারা বেশ তৃপ্তি করে পরিমাণে অনেকখানি খেয়ে ফেলল। অন্যদিকে, সেইসব বাচ্চারা, যাদের মাকে গর্ভধারণের সময়টাতে গাজরের জুস খেতে দেয়া হয়নি, তারা মোটামুটি ‘ইয়াক্’ বলে ফেলে দিল।
এইসব গল্প শুনে আপনি হয়তো আপনার বাচ্চার জম্নের ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন। যদি বাচ্চাকে রবীন্দ্র সংগীতে আগ্রহী করতে চান কিংবা গায়ক বানাতে চান, তাহলে গর্ভে থাকাকালীন সময়ে নিয়মিত ভালো ভালো গান শুনাতে পারেন। কিংবা ক্রিকেটার বানাতে চাইলে নিয়মিত দেখতে থাকুন উত্তেজনাকর ম্যাচগুলো। পরিবারের মাঝে বৌ-শাশুড়ি-ননদের জিলাপির প্যাঁচওয়ালা, একে অপরের পিছনে কুটনামি করা সিরিয়ালগুলি দেখবেন না দয়া করে।
তবে ব্যাপার কী জানেন, কেবল শব্দ-গন্ধ-স্বাদ নয়, গর্ভকালীন সময় পুরোটাই নবাগতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটা বিষয়ের বিশেষ তাৎপর্য আছে তার জন্য। গর্ভে থাকা অবস্থায় বাচ্চারা তার আশেপাশের পরিবেশের প্রত্যেকটাকে তথ্যের উৎস হিসাবে দেখে। তাই একে বলা যেতে পারে ‘বায়োলজিক্যাল পোস্টকার্ড’। ধারণা করা হয়, গর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের খাদ্যাভ্যাস, স্ট্রেস-লেভেল, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা এসব দেখে নবজাতক বাইরের দুনিয়ায় কি কি ঝামেলায় পড়তে পারে সে বিষয়ে ধারণা লাভ করে ও নিজেকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করে। হল্যান্ডে ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যেসব শিশু মায়ের পেটে ছিলো তাদের মাঝে এক গবেষণা চালানো হয়েছে। ঐসব শিশুদের অনেকের মাঝেই জন্মের পরপরই পুষ্টিস্বল্পতাসহ নানান রকম প্রসব-পরবর্তী সমস্যা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে অনেক সমস্যা বহুদিন পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। দেখা গেছে, ঐ সময়ে জন্ম নেয়া মানুষদের মাঝে পরবর্তিতে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। ধারণা করা হয়, জন্ম পূরবর্তী অভিজ্ঞতার কারণে তাদের দেহ নানান রকম পরিবর্তন এসেছে। যেমনঃ গ্লুকোজ হজম করার ক্ষমতা এদের কম, যেটা ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। তখন মায়ের শরীরের ব্লাড প্রেসারও ছিলো কম, যেকারণে পরবর্তী জীবনে এদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা গেছে।
যারা জেনেটিক্স নিয়ে কিছু জ্ঞান রাখেন, তারা হয়তো এতক্ষণে ভেবে থাকবেন যে, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো যত না গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল, তারও চেয়ে বেশি জেনেটিক; ডিএনএ প্রোফাইল মূলতঃ এসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। জেনেটিক প্রভাবের কথা অগ্রাহ্য না করেও গবেষকরা আসলে দেখাতে চেয়েছেন যে, গর্ভাবস্থাকালীন পরিবেশ মানুষের পরবর্তী জীবনের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, অনেক ক্ষেত্রে ডিএনএ এর প্রভাবও ছাপিয়ে যায়। দেখা গেছে, মোটা মায়ের সন্তানেরা সাধারণত মোটা হয়। গবেষকরা, মোটা মায়েদের মেদ-ভূড়ি কমানোর সার্জারির আগে ও পরে গর্ভধারণ করা সন্তানদের মধ্যে তুলনামূলক গবেষণা চালিয়েছেন। যেহেতু একই মায়ের সন্তান তারা, কাছাকাছি জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং খাদ্যাভ্যাসও একই রকম হয় তাদের। তারপরেও দেখা গেছে, সার্জারির পরে জন্ম নেয়া শিশুদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা সার্জারির আগে জন্ম নেয়া তার বড় ভাই-বোনদের অর্ধেক, আর ভীষণ মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তিন ভাগের এক ভাগ। পরবর্তীতে জন্ম নেয়া শিশুদের জন্মপূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার কারণে এপিজেনেটিক প্রসেসের মাধ্যমে তাদের বিপাক-প্রক্রিয়া স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মত দেন। এছাড়া, গর্ভাকালীন সময়ে মায়েদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বায়ু দূষণ, পরিবেশ দূষণ সব বিভিন্ন কারণে নবজাতকের মাঝে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসার ব্যাপারটা এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত।
গর্ভকালীন সময়ের উপর এসব গবেষণা আশার আলো দেখাচ্ছে আমাদের। আমেরিকার অ্যারিজোনাতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হার দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি। সেখানকার মানুষ ডায়াবেটিসকে পারিবারিক রোগ হিসেবে নিয়তি হিসেবেই ধরে নিয়েছে। তবে, গবেষকরা আশা করছেন, যদি গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের গ্লুকোজ লেভেল ঠিক রাখা যায়, তাহলে হয়তো নবজাতকের বিপাক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকবে ও ডায়াবেটিসের হার কমবে।
গবেষকরা তাদের গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বছর বার আগে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে এক প্রজেক্ট শুরু হয় – ২০০০ এরও বেশি বাচ্চাদের জন্ম-পূর্ববর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ইতোমধ্যে অ্যাজমা, এলার্জি, মোটা হওয়া, হৃদরোগ সহ বিভিন্ন রোগের জন্মপূর্ববর্তী উৎস সম্বন্ধে এ প্রজেক্ট আলোকপাত করতে শুরু করেছে। গবেষণা চলছে গর্ভাবস্থায় মায়েদের খাদ্যাভ্যাস রোগ প্রতিরোধে কাজে আসে কি না তার উপর। ইদুরের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁধাকপি বা ব্রকলির মতো সবজি থেকে তৈরি করা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ গর্ভবতী ইদুরের দেহে প্রবেশ করালে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে। এছাড়াও, আমেরিকাতে বিশাল বাজেটের ন্যাশনাল চিলড্রেন’স স্টাডিতে ২ বছর আগে ২০১০ সালে ১ম এক লক্ষ গর্ভবতী নারী নাম লেখাতে শুরু করেছিলেন। তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, পরীক্ষা করা হয়েছে ও হচ্ছে তাদের চুল-লালা-রক্ত-মূত্র থেকে শুরু করে তাদের বাসার বাতাস-ধূলা-পানি। সন্তানগণ ২১ বছর হওয়া পর্যন্ত এই নারী ও তাদের সন্তানদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ বছর তাদের গবেষনার ১ম ফল বের হওয়ার কথা যাতে অপরিণত শিশু-জন্ম ও জন্মগত ত্রুটি বিষয়ক কথা থাকবে। দেখা যাক, কী বের হয়।
সব কথার শেষ কথা, গর্ভকালীন সময়টা নবজাতকের পরবর্তী জীবনটার আদল গড়ে দেয়। এ সময়ে তাই মায়েদের জন্য সর্বোচ্চ সুস্থ পরিবেশ (শারীরিক ও মানসিক উভয়ই) নিশ্চিত করা অতি জরুরি।
সূত্রঃ
১)http://www.ted.com/talks/annie_murphy_paul_what_we_learn_before_we_re_born.html
২)http://www.time.com/time/magazine/article/0,9171,2021065,00.html
No comments:
Post a Comment