Wednesday, March 24, 2010

পিপাসা

গল্প করবে আমার সাথে একটু খানি?
টক ঝাল কিংবা মিষ্টি
ভাল হয় যদি মিশিয়ে দাও দু' চামচ পাগলামি।

Monday, March 22, 2010

গুলশান এক্সপ্রেস

বস্তার মধ্যে ধান ভরেছেন কখনো? কিংবা অন্য যেকোন প্রকারের মালামাল? তাহলে বস্তার উপরের দুই প্রান্ত ধরে ঝাঁকানাকা দেবার কথা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। পুরো ঠেসে মালামাল ভরার পরেও, একটুখানি ঝাঁকানাকার ফলে কোথা থেকে যে আরো জায়গা বের হয় - এমনটি ভেবে অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই কোন-না-কোন দিন। অবশ্য যদি কোনদিন আসলেই কাজটি আপনি করে থাকেন। এই ঝাঁকানাকার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সম্মান রেখেই বলছি- আমি এখন যে বাসখানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, সেটিকে যতই ঝাঁকানো হোক না কেন, আর একজন লোকও অতিরিক্ত নেয়া যাবে না তাতে।

৬ নম্বর বাসের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। দাঁড়িয়ে আছি না বলে যদি বলি "আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে" ভুল হবে না মোটেও। এদিক-ওদিক থেকে কত জন মিলে যে আমার শরীরটাকে ধাক্কা মেরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে- আমি ঠিক নিশ্চিত নই। এক হাতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি ওজনের ব্যাগ, যেটি পায়ের কাছাকাছি কোথাও আছে। আমার চক্ষুদ্বয়ের সাহস নেই যে ঘাড়কে বলে - "মাথাটা একটু নোয়াও তো, ব্যাগটা একটু দেখি"। অন্য হাতখানি আরেকজনের ঘাড়ের উপর দিয়ে কোন এক রড ধরে আছে। যদিও হাতখানির যুৎ হচ্ছে না তেমন, তবুও নড়তে পারছে না হাত দুটো, পাছে পাশের জনের নাকখানি ভেঙ্গে যায়।

পদার্থবিদদের এই মুহুর্তে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে- "আমার আর পাশের লোক শরীরের মধ্যে দূরত্ব কত?" কেউ যদি ফড়ফড় করে উত্তর দেয় 'শুন্য', তবে তাকে 'অপদার্থ' বলে গালি দেয়ার ইচ্ছেটাও ষোল আনা। আরে বাবা, ঐ লোকের চাপে আমি যে চ্যাপ্টা হয়ে গেলাম, আমার শরীর যে সংকুচিত হয়ে গেল, সেই হিসাব যাবে কোথায়? দেখে যাও পদার্থবিদগণ- দূরত্ব এখানে ঋণাত্মক!

আচ্ছা, আমি যদি এই মুহুর্তে আপনার  কাছে একটু সাহায্য চাই, করবেন? বেশি কিছু না, সামান্য, খুব সামান্য। অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে ভাল লাগে না, কিন্তু কী করি বলেন, আমার যে খুব দরকার। কীভাবে যে বলি... যাই হোক, বলেই ফেলি- "আমার চুলগুলো কপালের উপর এসে পড়েছে, অস্বস্তি লাগছে, সরিয়ে দিবেন? নাকটাও খুব চুলকাচ্ছে, একটু চুলকিয়ে দিবেন?"

Friday, March 19, 2010

জীবনচক্র


ব্যাঙের কথা মনে পড়ে? ব্যাঙের জীবনচক্রের কথা? ডিম-ব্যাঙাচি-লেজ-সাঁতার? মনে পড়ে কিছু? আবছা আবছা মনে পড়ে আমার। বিশেষ করে তীর চিহ্নের গোল গোল ছবির কথা। ঐ ছবিটা কিন্তু আমি বেশ ভালই আঁকতে পারতাম। বর্ণণা তো পারতাম তা তেমন, তাই পরীক্ষার খাতায় ছবিটাই ছিল ভরসা। স্যার/ম্যাডাম রা ছবি দেখেই [আর খাতায় আমার নাম দেখে ;)] নম্বর দিয়ে দিতেন। আমি নিজেও মুগ্ধ হয়ে যেতাম অন্যদের সাথে আমার আঁকা ছবি তুলনা করে।

খেয়াল করে দেখি আজও আমি সেই জীবনচক্রের ছবি ভালই এঁকে চলেছি। পেন্সিলের শিসে নয়, বাস্তবে। অফিস-বাসা-ঘুম-অফিস। এই করে চলছে...

Thursday, March 18, 2010

বজ্রপাত

১.
দাড়িয়াবান্ধার শেষ ঘরটা যখন পার হই-পার হই করছে আপন, ঠিক তখনি মায়ের উচ্চস্বরে ডাক- "আ-প--ন, দেইখ্‌খা যা কেডা আইছে..."।

ইসসস, এই সময় কেউ ডাকে! কিন্তু মায়ের কন্ঠে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু। দেরি করা যাবে না। আর এটাতো শেষ ঘর, এখানে আপনকে আটকাতে পারবে না কেউ। এক দিকে দ্রুত যাবার ভান করে, তারও চেয়ে দ্রুত গতিতে দিক পরিবর্তন করে দৌড়ে অন্য দিকের কোণা কেটে বেরিয়ে যায় আপন। দাড়িয়াবান্ধার দৌড় থামায় না সে। বাড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে বলে- "আমি গেলাম"।

এদিকে অপর পক্ষের অঞ্জন চিল্লাতে থাকে- "হয় নাই, হয় নাই, কোণা কাটা হয় নাই। পচ্চা। পচ্চা।" কিন্তু কে শুনে কার কথা! আপন ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে। মায়ের কন্ঠে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু।

ঘরে ঢুকেই অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠে আপন- "ইয়েয়েয়ে দহহহহন!"  তারপর হঠাৎই থেমে যায়। ঢাকার কাকা-কাকিরা অন্যদের চাইতে কেমন যেন ঠান্ডা-ঠান্ডা স্বভাবের। তারা হয়তো তার এই অকারণ চিৎকার পছন্দ করবে না। তবে চিৎকার থামালেও দহনের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে থামায় না- "আয়, খেলি গিয়া।" বেচারা দহন অল্পক্ষণের জন্য আমার-কোন-দোষ-নাই ভঙ্গিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রতিরোধের ক্ষীণ-থেকে-ক্ষীণতর চেষ্টা করে। এরপরই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দুজনে ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে মাঠে, যেখানে এখনো দাড়িয়াবান্ধা খেলা চলছে।

দহন আর আপন কাকাত-জেঠাত ভাই। দুজনেরই বয়স সমানে সমান- পিঠেপিঠি। দহন ১৭ দিনের ছোট। দহন ঢাকায় থাকে, আপন গ্রামের বাড়িতে। দুজনে খুব একটা দেখা হয় না, বছরে একবার কি সর্বোচ্চ দুবার। এবার দাদুর মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেছে তারা। দুদিন থাকবে।

দহনের ফিটফাট-বাবু-টাইপ চেহারা দেখে মাঠের সবাই ফিরে ফিরে তাকায় তার দিকে। আপন তাদের দিকে তাকায় 'আমার-ভাই' মার্কা ভাব নিয়ে। এরপর দহনকে জিজ্ঞেস করে-"খেলবি?"
দহন বলে- "কি?"
- "দাইড়া। পারস?"
দহন দুদিকে মাথা নাড়ে- "কিভাবে খেলে?"
- "আরে, এতো দুনিয়ার সোজা খেলা। এই যে লম্বা চিকন ঘরগুলা দেখতাছস, এইগুলাতে বিপক্ষ দলের মাইনসেরা খাড়াইয়া থাকব। আমরা, মানে আমগো দলের মাইনসেগো তাগোরে ফাঁকি দিয়া এই ঘরগুলা পার হইতে হইবো, এমুনভাবে পার হইতে হইবো বিপক্ষ দলের মাইনসে জানি ধরতে না পারে। ঘরগুলা একবার পার হইয়া ঐ পার যাইতে হইবো, আবার এইপার আইতে হইবো। তাইলে জিতা যামু।"
- "পারব না।" ইতস্তত করে দহন।
- "আরে পারবি।" অভয় দেয় আপন।

অন্যদের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক দেয় আপন- "অই, আমরা দুইজন খেলমু। আমগোরে এক দলে লওন লাগবো।"

সে খেলা শেষ হয়নি। তার আগেই বৃষ্টি এসে পড়ে। আর কোথা থেকে যেন ফুটবল এসে হাজির। দহন চলে আসতে চাইছিল, কিন্তু আপন আসতে দেয়নি। বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে তারা। কারো কোন দল নেই। যে যেদিক পারে বল নিয়ে যায়। তবে কেউই বেশি দূর নিতে পারে না। একটু পরই ধপাস! পিছলে পড়ে যায় পানিতে। কেউ কেউ দূর থেকে এসে ঘাসে স্লাইড করে বলের উপর পিছলে পড়ে। শুরুতে স্লাইড করেনি দহন, পরে এতই মজা পেয়ে যায় যে সে শুধুই স্লাইড করতে থাকে। দহনের ফিটফাট-বাবু-টাইপ চেহারায় যোগ হয় উচ্ছলতা।


২.
আজকের সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে দহনের মনে পড়ে সেই বৃষ্টির দিনের কথা। ফুটবল খেলা শেষে মায়ের অগ্নিচক্ষু এখনো চোখে ভাসে। অথচ কী দূরন্তই না ছিল আপনটা। বাড়ি এসে স্নান শেষে দহন যখন চুপচাপ বাবুর মত বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে ছিল, আপন তখন চুপিচুপি এসে ইশারায় ডাকে- "চল, চানাচুর খাইয়া আসি।" চানাচুর নয়, আপনের ডাকে কী যেন এক মাদকতা ছিল, সেই মাদকতার টানেই দহন গুটি গুটি পায়ে আপনের পিছু নেয়। আলো-আঁধারির সন্ধ্যায় তারা চলে যায় বাংলা ঘরের পিছনে। সেখান থেকে এক টুকরা টিন আর আরেকটা ভাঙ্গা কাচের বোতল কুড়িয়ে নেয় আপন। এরপর পিছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুজনে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। খানিকটা দূরে এক লোক কাঁধে বাঁশ রেখে, বাঁশের এক দিকে চানাচুর আর বাদামের বাক্স, অন্যদিকে পাটের বস্তা ঝুলিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আপন দৌড়ে ধরে তাকে। দহন চলে পিছু পিছু। টিন আর কাচের বোতলের বদলে চানাচুর কিনে তারা। বেশ আয়েশ করে চানাচুর খেতে থাকে তারা। একটা একটা করে চানাচুর। উফফ, কী ঝালই না ছিল!

চানাচুর খাওয়া শেষে যখন তারা বাড়ি ফিরছিল- তখনি দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল আবার। দুজনে ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে বাংলা ঘরের বারান্দায়। হব-হব সন্ধ্যা যেন হঠাৎ করেই রাত হয়ে গেল। কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে যাচ্ছিল দহন। আলো দেখলেই তাই দু'হাতে কান চেপে ধরছিল। এ দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল আপন। আলো দেখলেই তাই বলে উঠছিল- "কানে ধর, কানে ধর, উঠ-বস কর"। আর দহন কানে ধরলেই হো হো করে হেসে উঠছিল আপন।

আজ আবার বজ্রের শব্দ শুনতে ইচ্ছে করছে দহনের। বজ্রপাতের আলো দেখলেই দু'হাতে কান চেপে ধরছে। কিন্তু হায়, বজ্রপাতের শব্দ কোথায়? এতো কেবলই গাড়ির হর্ণের আওয়াজ! হর্ণের অত্যাচার সহ্য হয়ে গেছে, বজ্রপাত আর তাই ভয় জাগায় না। তবে কি হর্ণের আওয়াজ বজ্রপাতের চেয়েও তীব্র???

Tuesday, March 2, 2010

তাক্‌ ধি না ধিন্‌

রঙ-এর আজকের ছুটিটা অন্যরকম।

সেবার ক্লাস নাইনে রঙ স্কুলে যায়নি একদিন। জ্বর এসেছিল কি আসেনি মনে পড়ে না তার। সম্ভবতঃ এসেছিল, না হলে স্কুল ফাঁকি দেয়ার ছেলে সে নয়। তবে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে যে একদমই ছিল না, একেবারে নিঃসন্দেহ। মুরুব্বিদের ভাষ্যমতে পাড়ার ঐ অভদ্র আর বখাটে ছেলেগুলোর সাথে মার্বেল খেলে সেদিনের সকালটা কাটিয়েছিল সে। দুপুরটা পার করেছে ঘুমিয়ে। আর বিকেলে গিয়েছিল পাশের গ্রাম গনেরগাঁয়, ক্রিকেট খেলতে। দু' ম্যাচ করে খেলা হত প্রতিদিন। ১ম ম্যাচের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না যে রঙকে পাবে। ভাগ্যদেবী সেদিন ১ম ম্যাচের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। আনন্দে আনন্দে কাটিয়েছিল দিনটা।

পরদিন ১ম ক্লাসেই কিরণ স্যারের মুখদর্শন। কিরণ স্যারকে চেনে না এমন ছাত্র কিংবা ছাত্রী স্কুলে থাকতে পারে, তবে তাকে ভয় পায়না এমন কেউ বোধ করি ছিল না। যেমন ভাল তিনি পড়াতেন, তেমনি ভাল তিনি পিটাতেন। সবসময় যে তিনি পিটাতেন তা কিন্তু না, বড় জোর ২/৩ মাসে একদিন। কোনদিন তাকে বেত নিয়ে ক্লাসে আসতে দেখলেই সবার মধ্যে হিড়িক পড়ে যেত সেদিনের পড়া শিখার। সেদিনও তাকে আসতে দেখা গিয়েছিল বেত হাতে। যেসব ভাগ্যবান ছাত্র আগেই স্যারকে দেখেছে তারা আস্তে করে পিছনের দরজা দিয়ে চম্পট। ক্লাসে এসে রোল কল করার পরই স্যারকে সেই রূপে দেখা গেল, হাঁটুদ্বয়ের উপর দু' হাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার হতে উঠে দাঁড়ালেন- "গতকাল কে কে স্কুলে আসনি, দাঁড়াও।" দাঁড়াতে দাঁড়াতে রঙ ভাবছিল- তবে কি তাকে শায়েস্তা করতেই আজকের আয়োজন? এর আগে কোনদিন স্যারের কাছে ধরা খায়নি রঙ। ভাল ছাত্র বলে প্রায় সব শিক্ষকের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত সুবিধা পায় সে, আজ কি তার দেখা মিলবে না? প্রস্তুত রঙ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। স্যারও শুরু করলেন ১ম বেঞ্চের কোনা থেকে, রঙকে দিয়েই। চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করলেন- "গতকাল স্কুলে আসনি কেন?" মুখে কিছু বলে না রঙ, দ্রুত হৃদস্পন্দন কথা বলতে দেয় না তাকে।  খাতার মধ্য থেকে একখানা দরখাস্ত বের করে স্যারের হাতে দেয়, রঙের বাবার স্বাক্ষর আছে সেখানে। দরখাস্তটা বেঞ্চের উপর রাখেন স্যার। হৃদকম্পন বাড়ে রঙের, ঠোঁট কামড়ে ধরে চেয়ে থাকে স্যারের দিকে। স্যারের চোখের মনি এপাশ-ওপাশ করছে। দরখাস্ত পড়ার সময় বেশ শান্ত দেখায় স্যারকে, কিন্তু ঠিক ভরসা পায়না রঙ। কারণ সে জানে, যেদিন স্যার বেত মারেন, সেদিন ভয়ানক ঠান্ডা থাকে তার প্রকৃতি। একটু পর স্যার চলে এলেন তার নিজের চেয়ারের সামনে, হাতের ইশারায় বসতে বললেন সবাইকে। বেঁচে গেল সবাই। রঙ বুঝতে পারল- সেই ছিল আজকের লক্ষ্য। এ কারণেই কিরণ স্যারকে এত শ্রদ্ধা তার- ভাল ছাত্র বলে অযাচিত সুবিধা তিনি কাউকে দেন না। তবে দরখাস্তের উপযোগিতায় যারপর নাই মুগ্ধ হল রঙ।

তবে আজকের ছুটিটা অন্যরকম, এমনকি বৃষ্টির ছুটির মতোও নয়।

বৃষ্টির দিনে, সকালে তুমোল বৃষ্টি হত এমন দিনে, যেদিন কেউই তেমন স্কুলে যেত না, যেতে পারত না, সেদিন অতি অবশ্যই স্কুলে যেত রঙ। গিয়েই একখানা দরখাস্ত লিখত, দরখাস্ত লেখাকে বাস্তব কাজে লাগানোর দিকে বরাবরই বিশেষ আগ্রহ তার। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে অনেকে স্কুলে আসতে পারে নি, যারা এসেছে তাদের কাপড়-চোপড়ও ভিজা, তাই ছুটি চাই ১ম ঘন্টা শেষে। এরপর আরো দুয়েকজনকে নিয়ে ঘুরত ক্লাসে ক্লাসে ক্লাস-ক্যাপ্টেনের স্বাক্ষর নিতে, মেয়েদের ক্লাসগুলোতেও ঢু মারা যেত এই সুযোগে। শিক্ষকরাও খুব করে চাইতেন এমন ছুটি, তাই কোনবারই হতাশ হতে হয়নি রঙদের। সর্বোচ্চ ২য় ঘন্টার পর ছুটি পেয়ে যেত। তাক্‌ ধি না ধিন্‌ করে নাচতে নাচতে বাসায় চলে আসত রঙ। শিখাদি, অপুদি আর চম্পার সাথে লুডু খেলা যেত জম্পেশ করে। রবি দাদুর বাড়ি থেকে গরম গরম ভাজা বাদাম কিনে খেতে খেতে, টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে লুডু খেলা কী মজারই না ছিল!

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাছুটির ('অটো') চাইতেও আজকের ছুটি ভিন্ন ধরনের।

মনে পড়ে- প্রথমবার যেদিন তারা অটো নেয়, সেদিন ছিল বিশ্বকাপের প্রথম দিন। অটোর পর উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। কম্পিউটারে হাই ভলিউমে গান চালিয়ে দিয়ে তাস পিটাচ্ছিল রঙ ও তার কয়েকজন বন্ধু। শেষ পর্যন্ত সেই অটো ভাল কাটেনি রঙের। সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক আপু মারা গিয়েছিলেন সেদিন। গন্ডগোলে দু' মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও তেমন ছুটি কোনদিন চায় না রঙ।

প্রক্সির চেয়েও স্বতন্ত্র আজকের ছুটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে রঙ প্রায়ই অন্যদের প্রক্সি দিয়ে দিত। একবারতো ফুরিয়ার সিরিজ স্যারের ক্লাসে এক মেয়ের প্রক্সিও দিয়ে দিয়েছিল! রঙ নিজে যেমন অন্যের প্রক্সি দিত, তেমনি অন্যরাও তার প্রক্সি দিয়ে দিত প্রায়ই। বহুদিন বাঙ মেরে ক্যাফেতে তাস খেলেছে সে, কিন্তু ক্লাসের উপস্থিতি খাতায় অনুপস্থিত থাকেনি খুব একটা।

এমনকি চাকরিতে ঢুকার পরে বিনা কারণে অফিস ফাঁকি দিয়েও এত মজা পায়নি রঙ। বরং ছুটির দিনগুলোতে করার মত কিছু না পেয়ে প্রতিবারই বিরক্ত হয়েছে সে। শেষে ভেবেছে- অফিসে গেলেই বরং ভাল হত!

তাইতো আজকের ছুটিটা অন্যরকম।

অফিস থেকে আজ সে ছুটি নিয়েছে বই পড়ার জন্য। বইমেলা থেকে বেশ কিছু বই কিনেছে, পড়া হয়নি। বই পড়ার অভ্যেসটা চলে গেছে বলে প্রায়ই আফসোস করত রঙ, আর ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেত। অভ্যেসটা আজ আবার ফিরে এসেছে। সকালে উঠেই মনে হয়েছে আজ তার বই পড়ার দিন। অফিসের শৃঙ্খল থেকে মনকে মুক্তি দেয়ার দিন। আজ তার জাগরণের দিন। মনটা নেচে উঠেছে কি? তাক্‌ ধি না ধিন্‌ ...