Thursday, March 18, 2010

বজ্রপাত

১.
দাড়িয়াবান্ধার শেষ ঘরটা যখন পার হই-পার হই করছে আপন, ঠিক তখনি মায়ের উচ্চস্বরে ডাক- "আ-প--ন, দেইখ্‌খা যা কেডা আইছে..."।

ইসসস, এই সময় কেউ ডাকে! কিন্তু মায়ের কন্ঠে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু। দেরি করা যাবে না। আর এটাতো শেষ ঘর, এখানে আপনকে আটকাতে পারবে না কেউ। এক দিকে দ্রুত যাবার ভান করে, তারও চেয়ে দ্রুত গতিতে দিক পরিবর্তন করে দৌড়ে অন্য দিকের কোণা কেটে বেরিয়ে যায় আপন। দাড়িয়াবান্ধার দৌড় থামায় না সে। বাড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে বলে- "আমি গেলাম"।

এদিকে অপর পক্ষের অঞ্জন চিল্লাতে থাকে- "হয় নাই, হয় নাই, কোণা কাটা হয় নাই। পচ্চা। পচ্চা।" কিন্তু কে শুনে কার কথা! আপন ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে। মায়ের কন্ঠে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু।

ঘরে ঢুকেই অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠে আপন- "ইয়েয়েয়ে দহহহহন!"  তারপর হঠাৎই থেমে যায়। ঢাকার কাকা-কাকিরা অন্যদের চাইতে কেমন যেন ঠান্ডা-ঠান্ডা স্বভাবের। তারা হয়তো তার এই অকারণ চিৎকার পছন্দ করবে না। তবে চিৎকার থামালেও দহনের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে থামায় না- "আয়, খেলি গিয়া।" বেচারা দহন অল্পক্ষণের জন্য আমার-কোন-দোষ-নাই ভঙ্গিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রতিরোধের ক্ষীণ-থেকে-ক্ষীণতর চেষ্টা করে। এরপরই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দুজনে ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে মাঠে, যেখানে এখনো দাড়িয়াবান্ধা খেলা চলছে।

দহন আর আপন কাকাত-জেঠাত ভাই। দুজনেরই বয়স সমানে সমান- পিঠেপিঠি। দহন ১৭ দিনের ছোট। দহন ঢাকায় থাকে, আপন গ্রামের বাড়িতে। দুজনে খুব একটা দেখা হয় না, বছরে একবার কি সর্বোচ্চ দুবার। এবার দাদুর মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেছে তারা। দুদিন থাকবে।

দহনের ফিটফাট-বাবু-টাইপ চেহারা দেখে মাঠের সবাই ফিরে ফিরে তাকায় তার দিকে। আপন তাদের দিকে তাকায় 'আমার-ভাই' মার্কা ভাব নিয়ে। এরপর দহনকে জিজ্ঞেস করে-"খেলবি?"
দহন বলে- "কি?"
- "দাইড়া। পারস?"
দহন দুদিকে মাথা নাড়ে- "কিভাবে খেলে?"
- "আরে, এতো দুনিয়ার সোজা খেলা। এই যে লম্বা চিকন ঘরগুলা দেখতাছস, এইগুলাতে বিপক্ষ দলের মাইনসেরা খাড়াইয়া থাকব। আমরা, মানে আমগো দলের মাইনসেগো তাগোরে ফাঁকি দিয়া এই ঘরগুলা পার হইতে হইবো, এমুনভাবে পার হইতে হইবো বিপক্ষ দলের মাইনসে জানি ধরতে না পারে। ঘরগুলা একবার পার হইয়া ঐ পার যাইতে হইবো, আবার এইপার আইতে হইবো। তাইলে জিতা যামু।"
- "পারব না।" ইতস্তত করে দহন।
- "আরে পারবি।" অভয় দেয় আপন।

অন্যদের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক দেয় আপন- "অই, আমরা দুইজন খেলমু। আমগোরে এক দলে লওন লাগবো।"

সে খেলা শেষ হয়নি। তার আগেই বৃষ্টি এসে পড়ে। আর কোথা থেকে যেন ফুটবল এসে হাজির। দহন চলে আসতে চাইছিল, কিন্তু আপন আসতে দেয়নি। বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে তারা। কারো কোন দল নেই। যে যেদিক পারে বল নিয়ে যায়। তবে কেউই বেশি দূর নিতে পারে না। একটু পরই ধপাস! পিছলে পড়ে যায় পানিতে। কেউ কেউ দূর থেকে এসে ঘাসে স্লাইড করে বলের উপর পিছলে পড়ে। শুরুতে স্লাইড করেনি দহন, পরে এতই মজা পেয়ে যায় যে সে শুধুই স্লাইড করতে থাকে। দহনের ফিটফাট-বাবু-টাইপ চেহারায় যোগ হয় উচ্ছলতা।


২.
আজকের সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে দহনের মনে পড়ে সেই বৃষ্টির দিনের কথা। ফুটবল খেলা শেষে মায়ের অগ্নিচক্ষু এখনো চোখে ভাসে। অথচ কী দূরন্তই না ছিল আপনটা। বাড়ি এসে স্নান শেষে দহন যখন চুপচাপ বাবুর মত বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে ছিল, আপন তখন চুপিচুপি এসে ইশারায় ডাকে- "চল, চানাচুর খাইয়া আসি।" চানাচুর নয়, আপনের ডাকে কী যেন এক মাদকতা ছিল, সেই মাদকতার টানেই দহন গুটি গুটি পায়ে আপনের পিছু নেয়। আলো-আঁধারির সন্ধ্যায় তারা চলে যায় বাংলা ঘরের পিছনে। সেখান থেকে এক টুকরা টিন আর আরেকটা ভাঙ্গা কাচের বোতল কুড়িয়ে নেয় আপন। এরপর পিছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুজনে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। খানিকটা দূরে এক লোক কাঁধে বাঁশ রেখে, বাঁশের এক দিকে চানাচুর আর বাদামের বাক্স, অন্যদিকে পাটের বস্তা ঝুলিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আপন দৌড়ে ধরে তাকে। দহন চলে পিছু পিছু। টিন আর কাচের বোতলের বদলে চানাচুর কিনে তারা। বেশ আয়েশ করে চানাচুর খেতে থাকে তারা। একটা একটা করে চানাচুর। উফফ, কী ঝালই না ছিল!

চানাচুর খাওয়া শেষে যখন তারা বাড়ি ফিরছিল- তখনি দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল আবার। দুজনে ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে বাংলা ঘরের বারান্দায়। হব-হব সন্ধ্যা যেন হঠাৎ করেই রাত হয়ে গেল। কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে যাচ্ছিল দহন। আলো দেখলেই তাই দু'হাতে কান চেপে ধরছিল। এ দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল আপন। আলো দেখলেই তাই বলে উঠছিল- "কানে ধর, কানে ধর, উঠ-বস কর"। আর দহন কানে ধরলেই হো হো করে হেসে উঠছিল আপন।

আজ আবার বজ্রের শব্দ শুনতে ইচ্ছে করছে দহনের। বজ্রপাতের আলো দেখলেই দু'হাতে কান চেপে ধরছে। কিন্তু হায়, বজ্রপাতের শব্দ কোথায়? এতো কেবলই গাড়ির হর্ণের আওয়াজ! হর্ণের অত্যাচার সহ্য হয়ে গেছে, বজ্রপাত আর তাই ভয় জাগায় না। তবে কি হর্ণের আওয়াজ বজ্রপাতের চেয়েও তীব্র???

6 comments:

মিঠু said...

like.

aneway, mon kharap kora lekha na likhle ki chole na tomar? :(

আলোর ছটা said...

thanks :)

anyway, this is fact :(

জনৈক আরাফাত said...

ভালো লিখিছিস, দাদা!

আলোর ছটা said...

@আরাফাতঃ উৎসাহ পেলুম :)

mahmud said...

ভাইয়া,
দহনরা তো তাও দু'একবার বজ্রপাত শুনেছে, গ্রামের বাড়িতে 'দাইরা" খেলেছে...
আগামীর দহনদের কী হবে বলতে পারেন? ওরা কী ব্লগে লিখবে "ছেলেবেলায় রাস্তায় হর্ণের আওয়াজ শুনতাম... কী মধুর সেই হর্ণ... এখনকার হর্ণ বড় বেশি জোরে বাজে... "

হাহাহা... কৌতুক করলাম। আসলে আমার এই প্রশ্ন মাথায় আসে মাঝে মাঝে। প্রকৃতির স্পর্শ না পেলে সাহিত্যের উপকরণ কী হওয়া সম্ভব সেটা মাথায় আসেনা। কিন্তু অবধারিতভাবেই কিছুকাল পর নতুন প্রজন্ম এই প্রকৃতির সান্নিধ্য কীভাবে বা কতটুকু পাবে সেইটা প্রশ্নবিদ্ধ একটা ব্যাপার...

নাকি বলেন ভাইয়া? লেখাটা পড়ে তো ভিতর উগলিয়ে কথা বেরিয়ে এলো আমার... :P
মতামতটা জানতে চাই।

আলোর ছটা said...

@ফয়সালঃ সাহিত্য তার আপন গতিতে চলে। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরুর কথা কিন্তু এখন কেউ বলে না, আমাদের 'দাইড়া'-র কথাও একদিন কেউ লিখবে না। এই বোধ হয় রীতি...