Sunday, October 5, 2008

উল্টো পিঠের গল্প

মিঃ সূর্যকে 'বিশ্ব আলোক সমিতি' শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করেছে। - খবরটা শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন মিঃ প্রদীপ। সরাসরি মামলা ঠুকে দিলেন 'বিশ্ব আলোক সমিতি'র বিরুদ্ধে। কারণ কি? কারণ হল - যে সভায় সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে - মিঃ সূর্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, সে সভায় মিঃ প্রদীপের গুণাবলি আলোচনায়ই আনা হয়নি। এদিকে মিঃ প্রদীপ নিজেকেই শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন। এমন গুণীজনের এহেন অসম্মান! তাইতো মামলার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও দাবি করে বসেছেন তিনি।

শুনানির তারিখ দেয়া হল। যথাসময়ে মিঃ সূর্য, মিঃ প্রদীপ ও তাদের পক্ষের আইনজীবীরা হাজির হলেন আদালতে। শুরু হল তর্ক-বিতর্ক। মিঃ প্রদীপের পক্ষের উকিল শুরুতেই তার মক্কেলের বক্তব্য পেশ করলেন জজ সাহেবের নিকট। এখানে বলে রাখা ভাল যে, এ উকিল বাংলাদেশের এক ক্ষুদে উকিল, নাম মোঃ আমিন। অন্যদিকে 'বিশ্ব আলোক সমিতি' মিঃ সূর্যের পক্ষে লড়ার জন্য নিয়োগ করেছে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারিকৃত ড. স্টিফেন লি - কে।

ড. স্টিফেন লি শুরু করলেন এভাবে - "মিঃ সূর্য একজন মহানুভব, উদার, বিশালাকায়, ঐশ্বর্যশালী, সর্বোপরি আদর্শ ব্যক্তিত্ব।"

আমিন বাধা দিয়ে বলেন, "মহামান্য আদালাত, মিঃ সূর্যকে আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে মানতে রাজি নয় আলোক সমাজ। আর এজন্যইতো এই মামলা। আমার প্রতিপক্ষের উকিলের করা বিশেষণগুলো আপাতত তুলে নেয়ার জন্য আমি আবেদন করছি, মহামান্য আদালত।"

জজঃ আবেদন মঞ্জুর করা হল।

বিশেষণ তুলে নিয়ে এবার ড. স্টিফেন লি সরাসরি তার বক্তব্য শুরু করলেন - "Your Honour, মিঃ সূর্য বিভিন্ন দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। প্রথমতঃ আমরা আসি আকারের দিকে। সূর্যের আকার-আয়তন বিশাল, অন্যদিকে মিঃ প্রদীপের আয়তন নগণ্য।"

আমিনঃ বিজ্ঞ আইনজীবী প্রশ্ন তুললেন আকার নিয়ে, কে কতখানি লম্বা-বেটে তা নিয়ে। কিন্তু উনি কি এই প্রবাদটা জানেন না যে, লম্বা যত, আহাম্মক তত। তাই প্রশ্ন হল, এ বিশাল আকার কি শ্রেষ্ঠত্বের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়?

লিঃ Your honour, আমার প্রতিপক্ষের উকিল পরোক্ষে আমার মক্কেলকে আহাম্মক বলেছেন। অবশ্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা অন্যের মন্তব্যের ধার ধারে না। এই আপত্তিকর উপমাও আমার client এর ব্যক্তিত্বকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারবে না, Your honour.

জজঃ সম্মানিত আইনজীবীগণ, আপনারা নিজেরাই সবার সামনে একে অপরের নিকট নিজেদের যুক্তি তুলে ধরুন। তাহলে মনে হয় আপনাদের উভয়েরই ভাল হবে।

আমিনঃ ধন্যবাদ, মহামান্য আদালত।

লিঃ মিঃ আমিন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, মিঃ সূর্য কত দূর থেকে আলো দেয়। এত দূর থেকে আলো দেয়ার ক্ষমতা কি আপনার client এর আছে?

[এ সময় মিঃ প্রদীপের মুখখানা কালো হয়ে গেল।]

আমিনঃ দূর থেকে আলো দেয়ার কথা বলছেন, লি সাহেব? দূর থেকে আলো দেয়ার অনেক অসুবিধে। যেমনঃ আকাশে কালো মেঘ জমা হলে সুর্যের আলো হ্রাস পেয়ে যায়। কিন্তু আমার মক্কেলের বেলায় এ বাধা নেই।

[কালো মুখ ফর্সা হয়ে উঠল মিঃ প্রদীপের।]

লিঃ মিঃ সূর্য যে বিশাল পরিমাণ আলো পাঠায় - সে কারণে তাঁর ক্ষমতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে সম্পুর্ণ আলোক সমাজ।

আমিনঃ মিঃ সূর্যের সব আলো তো আর মানব সভ্যতার কাজে লাগে না, বেশিরভাগই অপচয় হয়। আর অপচয়কারী শয়তানের বন্ধু, মহান আল্লাহতা'লা তাকে ঘৃণা করেন। আর মিঃ প্রদীপের বেলায় দেখুন - তিনি কত মিতব্যয়ী! মিতব্যয়িতা একটা প্রধান গুণ, যার জন্য একে অন্যের শ্রদ্ধাভাজন হতে পারে।

লিঃ আচ্ছা মিঃ আমিন, মিঃ সূর্যের নিয়মানুবর্তিতার কথা ভাবুনতো একবার। উনি পূর্ব দিকে উঠেন, আর পশ্চিমে অস্ত যান। এই বিশাল গুণের কারণে পাঠ্যপুস্তকে Translation পর্যন্ত আছে। আর Discipline কিংবা নিয়মানুবর্তিতা রচনায় তাঁর উদাহরণও দেওয়া হয়। এটা কি একটা বিশাল plus point না?

আমিনঃ দুঃখিত, মিঃ সূর্য খুবই নিয়মানুবর্তী - একথা মানতে রাজি নই আমি। আর তিনি পূর্ব দিকে উঠেন, আর পশ্চিমে অস্ত যান - এ কথাটাও ভুল। লক্ষ্য করলে দেখবেন - উদয় আর অস্ত এ দুই দিকের মধ্যবর্তী কোণটা সবসময় ১৮০ ডিগ্রী হয় না। একথা সূর্য মহাশয় জেনেও প্রতিবাদ করেন না। আমি বুঝতে পারিনা এ কেমন শ্রেষ্ঠত্ব। অন্যদিকে মিঃ প্রদীপকে যখন যেখানে খুশি জ্বালানো হয়, তখন সেখানেই তিনি জ্বলেন। আমি মনে করি- এটাই বড় নিয়মানুবর্তিতা।

লিঃ মিঃ আমিন, আপনি দেখুন, মিঃ সূর্য কত মহানুভব! তিনি নিজের আলো দিয়ে অন্যকে সাহায্য করেন। যেমনঃ চন্দ্র আলোকিত হয় আমার client এর আলোয়।

আমিনঃ হ্যাঁ, আমি মেনে নিলাম - এখানে সূর্য মহাশয় উদারতার পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু এমন কোন মহানুভবতা দেখানোর দরকার নেই যার জন্য অন্যের নৈতিকতা নষ্ট হয়। মিঃ সূর্য চন্দ্রকে যে আলো দেন, তা কি চন্দ্রবাবু কোনদিন ফেরত দিয়েছেন? না দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন? চন্দ্র কি এতে পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছেন না? আর কাউকে পরনির্ভরশীল হতে ইন্ধন যোগানো নিশ্চয়ই কোন ইতিবাচক গুণাবলি হতে পারে না।

লিঃ দেখুন মিঃ আমিন, মিঃ প্রদীপ হতে যখন আগুন লেগে যায়, নষ্ট হয় প্রচুর রাজস্ব, তখন তাকে কি ইতিবাচক গুণ হিসেবে অভিহিত করবেন? মিঃ সূর্যের কিন্তু এমন ইতিবাচক গুণ নেই।

আমিনঃ আগুনের কথা যখন উঠলই, তাহলে বলতে হয়, আগুনের অপকারিতা যেমন আছে, তেমনি উপকারিতাও আছে। দেখুন লি সাহেব, আমাদের সভ্যতার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে কিন্তু আগুন হতেই। আর এখনও আগুনের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। অতএব, আগুন আমাদের জ্বালাতেই হবে। সে আগুন সহজেই জ্বালানো যায় আমার মক্কেলের কাছ থেকে, আর মিঃ সূর্যের আলো হতে আগুন জ্বালাতে দরকার হয় দামী কিন্তু বিপজ্জনক ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস। হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পারেন, লি সাহেব, আমার মক্কেলের শিখা মাঝে মাঝে ক্ষতি করে থাকে। কিন্তু মিঃ প্রদীপ এ ক্ষতির জন্য অর্থাৎ আগুন লাগানোর জন্য দায়ী নন, বরং দায়ী তারা, যারা এ শিখা ব্যবহার করেন।

লিঃ আগুন লাগার কথা বাদ দিলেওতো আরো বলা যায়, মিঃ প্রদীপের কারণে ঘরবাড়ি কালো হয়ে যায়, কিছুদিন পরপর বাড়িতে রং-বার্ণিশ করতে হয়। প্রচুর খরচ হয় এতে।

আমিনঃ লি সাহেব, সূর্যের আলোতে হয়তো ঘরবাড়ি কালো হয় না, কিন্তু এই আলোতে চলার কারণে মানুষের গায়ের রঙ কালো হয়ে যায়। এ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ যে কত শত সানপ্সক্রীন, ভ্যানিশিং ক্রীম, টারমারিক ক্রীম, বডি লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করে তার ইয়ত্তা নেই। এতে কি ঘর রঙ করার চেয়ে খুব কম খরচ লাগে?

লিঃ Your honour, আমি এখন মিঃ সূর্যের সবচেয়ে বড় গুণটির কথা বলছি। এটা সকলেই জানেন যে, সুর্যের আলো হতে শক্তি শোষণ করে উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করে। আর মানুষ উদ্ভিদের ত্যাগ করা অক্সিজেন শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে, Your honour। আপনি, আমি, আমার প্রতিপক্ষের আইনজীবী, আমরা সবাই এর মাধ্যমেই বেঁচে আছি। এ কারণেই মিঃ সূর্যকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে মানতে কোন বাধা নেই।

আমিনঃ হ্যাঁ, মিঃ সূর্যের এ গুণটা তার একটা ভাল দিক - একথা মানতে আমার কোন বাধা নেই।

[এসময় মুচকি হাসি ফুটে উঠল ড. স্টিফেন লি'র মুখে। মিঃ সূর্যও তার তাপ বাড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করে উঠলেন।]

আমিনঃ কিন্তু আমি যে বিষয়টার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হল - এখানে প্রশ্ন তুলা হয়েছে ষ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে, কেবল একটা গুণ নিয়ে নয়। মিঃ সুর্য ও মিঃ প্রদীপ দুজনেই তাদের স্ব স্ব কাজ করে যাবেন - নিজে শ্রেষ্ঠ হলেও, আবার না হলেও। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল - শ্রেষ্ঠ কে? মিঃ সুর্যের যেমন একটা গুণের কথা বললেন মিঃ লি, আমিও তেমনি মিঃ প্রদীপের অনেক অনেক গুণের কথা বলতে পারি। সূর্যের আলোতে সানগ্লাস পরতে হয়, কিন্তু মিঃ প্রদীপের বেলায় তার দরকার হয় না। মিঃ সূর্যের বিচ্ছুরিত আলোয় বরফ গলে বন্যা হয়ে যায়, জনজীবনে দুঃখ বাড়ে। আবার তার প্রখর আলোয় কোথাওবা সৃষ্টি হয় মরুভূমির। কিন্তু মিঃ প্রদীপ তৈরি করে স্নিগ্ধ, মোলায়েম, মনোরম একটা পরিবেশ। প্রদীপের আলো ব্যবহৃত হয় জন্মদিন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মানুষকে আনন্দ দানে। আর মিঃ প্রদীপের সবচেয়ে বড় গুণ হল, উনাকে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা পাওয়া যায়, কিন্তু মিঃ সূর্যকে পাওয়া যায় না। আমি আবারো বলছি, মহামান্য আদালত, কোন বিশেষ একটা গুণের কারণে কেউ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হতে পারেন না। এজন্য প্রয়োজন অনেক গুণের সমষ্টি। আর আমার মক্কেল মিঃ প্রদীপের মাঝে তা আছে। আমার আর কিছু বলার নেই, মহামান্য আদালত। লি সাহেব যদি কিছু বলতে চান, বলতে পারেন।

লিঃ Your honour, আমিন সাহেব নিজ মুখেই সবার সামনে স্বীকার করে গেলেন, মিঃ সূর্যের মহৎ গুণ হল - সূর্যালোক হতে উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করে, আর উদ্ভিদের কারণেই আমরা বেঁচে আছি। এই বিরাট গুণের কথা উল্লেখ করার পর আমারও কিছু বলার নেই, Your honour।

[রায় জানার জন্য সবাই চুপচাপ হয়ে গেল।]

জজঃ উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্কিই আমরা এতক্ষণ শুনলাম। এগুলোর বিচারে এ আদালত মনে করে- মিঃ প্রদীপ মিঃ সুর্য অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। আর মিঃ প্রদীপের এসব গুণ বিবেচনায় না আনায় উনার সম্মানের যে হানি ঘটেছে সে কারণে 'বিশ্ব আলোক সমিতি'কে ১৩ মিলিয়ন ইউ.এস. ডলার জরিমানা করা হল। এ অর্থের ১৭.২৫ ভাগ সরকারকে কর দেয়া হবে এবং বাকি অংশ মিঃ প্রদীপকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হবে। আদালত আজকের মতো এখানেই মূলতবি ঘোষণা করা হল।

সূর্যের সামনে মনে হচ্ছে কালো মেঘ জমা হচ্ছে। দিন প্রায় শেষভাগে, রাত প্রায় আসন্ন।

4 comments:

আলোর ছটা said...

অনেক দিন আগের লেখা... সেই কলেজ লাইফে।

ফেরারী ফেরদৌস said...

যুক্তি, পাল্টা যুক্তিগুলো ভারি মজার :)

AMIT said...

kotha gulo onek valo legeche....
chaliye ja,ashis...
ur logic is really rocking...

আলোর ছটা said...

@ফেরারী ফেরদৌসঃ কেউ মজা পাইলে আমিও খুশি :)

@amit: is? নাকি was? :P