সেই প্রথম যখন বুয়েটে এলাম, অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতাম সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের দিকে। আর যখন শুনতাম- উনি ৩/২ বা ৪/২ তে পড়েন, ধাঁধিয়ে যেত চোখ - ‘ওম্মা, এত্ত সিনিয়র!’ বড়দের সামনে স্বভাবতই ভদ্র হয়ে যেতাম। কখনোই বলবনা জোর করে ভদ্র হতাম, ভদ্র হতাম তাদের সম্মানে, মন থেকেই হতাম। যেমন- হয়তো বারান্দায় ছুটোছুটি করছিলাম এদিক-ওদিক - এমন সময় পড়ে গেলাম এক ভাইয়ার সামনে। এখন কি করি? পড়িমড়ি করে থামলাম। বিনয়ী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম - ‘কেমন আছেন ভাইয়া?’ ... আবার কোন সময় হয়তো বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমীতে ব্যস্ত - এমন সময় উদয় হলেন একজন। অতএব গুল্লি মারি দুষ্টুমী আর কোলাহলের। ভাইয়ার দিকে চেয়ে হাসি- অপরাধের হাসি। উনার চোখে-মুখেও যেন তির্যক হাসি - ‘ধরে ফেলেছি, ধরে ফেলেছি’ ভাব।
ভাবতেই কেমন অবাক লাগে- আজ আমি সেই ভাইয়াদের দলে। আজ আমি ৪/২ তে। জানিনা জুনিয়ররা কীভাবে দেখে আমায়। তবে তাদের দেয়া ফ্লোর বিদায়, অমুক বিদায়, তমুক বিদায় আমাকে কেবলই মনে করিয়ে দেয় - বুয়েট লাইফ প্রায় শেষ। শেষ সময়টায় নস্টালজিয়াকে এড়াতে পারিনা অনেকের মতো আমিও। মনে পড়ে টুকরো-টুকরো অনেক ঘটনা, টুকরো-টুকরো স্মৃতি। স্মৃতি হাতড়িয়ে খুঁজে বেড়াই চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান। মিলাতে চেষ্টা করি জীবনের জাবেদা। কী করতে পারলাম আর কী পারলাম না- এ হিসাবের ডেবিট-ক্রেডিট মিলেনা কিছুতেই। না পারার দিকটাই এগিয়ে, বড্ড বেশি এগিয়ে। এটুকু জীবনে সবচেয়ে বড় সাফল্য যদি হয় বুয়েটে চান্স পাওয়া, ব্যর্থতাটাও থাকবে তার পাশেই- রেজাল্ট যে ভাল না। রেজাল্টের দিকটা ছাড়লেও যেতে পারতাম প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের দিকে। যাওয়া হলনা সেদিকেও। পড়াশুনার দিকটাই ছেড়ে দিলাম। খেলাধূলাতো এখনও আছে। তবে সেখানে আমি বরাবরই দ্বাদশ ব্যক্তি (১১ জনের দলে)। আরও বাকি সাংস্কৃতিক দিক- যে দিকটায় একদমই অপাঙতেয় আমি। দুরবস্থার কথা কী আর বলব - ‘হ্রস্ব-উ-কার’ আর ‘উ-কার’ [তুমি আর তোমার] কিংবা ‘এ-কার’ আর ‘য-ফলা+আ-কার’ [নেশা আর ন্যাকা] এসবের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলি এখনও। হয়তো উল্লেখযোগ্য নয়- তবুও না পারার মিছিলে আরও যোগ দেয় নারী। মিছিলের শ্লোগাণে শ্লোগাণে আত্মবিশ্বাসের ভীতখানিও কেঁপে উঠে কিছুটা।
তবুও আত্মবিশ্বাসের সাথে এটুকু বলতে পারি- ভালকে ভাল আর খারাপকে খারাপ বলতে পারার মনটাকে ধরে রাখতে পেরেছি। এখনও বন্ধুর সুখে হাসতে পারি, কাঁদতে পারি তার দুঃখে। কারো কোন ভাল করতে পারলে এখনও শান্তি পাই মনে [এজন্য বাঁধন (স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন)-এর কাছে যার পর নাই কৃতজ্ঞ]। এখনও আমি বন্ধুর সাথে লক্ষ্যহীন ম্যারাথন আড্ডা দিতে পারি, হাসতে পারি প্রাণ খুলে কিংবা অসংকোচ ভিজতে পারি বৃষ্টি এলে ... ... ... এখনও আমি স্বপ্ন দেখতে পারি।