ছোটবেলা থেকেই আমার একটা স্বভাব আছে - ভাল নাকি মন্দ সে ব্যাপারে এখন মাঝেমাঝেই সন্দেহ হয়, তবে অতি অবশ্যই সাধারণের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষাকে কেবল বইয়ের পাতায় আর পরীক্ষার খাতায় সীমাবদ্ধ রাখতাম না। অনুসরণ করতাম জীবনাচরণে, অন্ততঃ চেষ্টা করতাম। বই আর বাস্তবের মধ্যে ব্যতিক্রম দেখলে তাই প্রশ্ন করতাম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌক্তিক উত্তর মিলতো না। নিজের জ্ঞান আর যুক্তিবোধ দিয়ে নিজের পথ বেছে নিতাম।
ক্লাস থ্রী কিংবা ফোরের কথা। ধর্ম বইয়ে পড়েছিলাম পৃথিবীর চার যুগের কথা - সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। প্রতিটা যুগের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিলো সত্য আর মিথ্যার অনুপাতে। সত্য যুগে মানুষ ১০০ ভাগ সত্য কথা বলতো, ত্রেতা যুগে ৭৫ ভাগ সত্যের সাথে ২৫ ভাগ মিথ্যা, দ্বাপর যুগে অর্ধেক সত্য আর অর্ধেক মিথ্যা। আর আমরা আছি কলি যুগে যখন মানুষ ৭৫ ভাগ মিথ্যার সাথে কখনো কখনো (২৫ ভাগ) সত্য বলে। মিলিয়ে দেখলাম চারপাশের সাথে। ঠিকইতো। আমরা এত মিথ্যা বলি যে, মেনে নিলাম ধর্ম বই ঠিকই বলছে। এরপর ক্লাস ফাইভে এক নতুন শিক্ষক এসেছেন। আমাদের অংক ক্লাস নেন। বেশ ভালো পড়ান। অন্য অনেকের মতো প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন না, বা ধমক দিয়ে বসিয়ে দেন না। উনি একদিন পড়াচ্ছেন- ১২ বছরে ১ যুগ। আমার মধ্যে দন্দ্ব দেখা দিলো - কোথাও কোন গন্ডগোল আছে। সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ধর্ম বইয়ে পড়লাম যুগ আছে ৪টা। আপনি বলছেন ১২ বছরে ১ যুগ। তার মানে কি ১২x৪=৪৮ বছর ধরে পৃথিবী আছে? কিন্তু তা তো না। তাহলে?
আমাদের গ্রামে কল্কি-নারায়ণ পূজার চল শুরু হলো এক সময়। কল্কি-নারায়ণ এক মস্ত ক্ষমতাধর দেবতা, যদিও তার কথা কোন ধর্ম বইয়ে পাইনি। তার কাছে মানত করে কিছু চাইলে সে মনোবাঞ্ছা পূরণ হবেই, বাধা-বিপত্তি দূর হবেই, রোগ-শোক সারবেই। তবে, একটা ঝামেলা আছে। মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়ার ২১ দিনের মধ্যে তার পূজা দিতে হবে, না হলে মহাবিপদ। সে পূজায় একজন পূজারী কল্কি-নারায়ণের কাছ থেকে মানুষের ইচ্ছাপূরণের ও পরবর্তীতে তার পূজা না দেয়ার পরিণতির গল্প বলে। গল্পটা ভালোই লাগতো শুনতে। আমি গল্প শুনতে যেতাম। গল্পের পর ৩, ৫ কিংবা ৭ জন মানুষ একত্রে বসে কল্কি টানে। কল্কিতে নিয়ে তামাক টানা আর কি। এই তামাক টানাটা মানতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই সিগারেট আর তামাককে এতটা খারাপ চোখে দেখতাম যে, তামাক টানাকে কখনোই ধার্মিকতা মনে হয়নি। আমি যখন বলতাম, তামাক খাওয়া ভালো না, তখন তারা বলতো ঠাকুরের জন্য তামাক খাওয়া খারাপ না। এরপর তাদেরকে ধর্ম বই দেখিয়েছিলাম, যেখানে লিখা আছে, "মনুসংহিতায় আছে, তামাক খেলে পরজন্মে শূকর হয়ে জন্মাতে হয়"। এরপর জিজ্ঞেস করেছিলাম, কল্কি-নারায়ণ পূজার নামে তামাক খাওয়া কি ধর্মসম্মত? কারো মুখে রা ছিলো না। আমার মা তখন আমাকে ধমক দিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করেছিলেন।
বিভিন্ন বইয়ে, বিশেষ করে বাংলা, সমাজ ও ধর্ম বইয়ে, নীতিকথা থাকতো। প্রতিটা মানুষ সমান, কাউকে ছোট করে দেখতে নেই, জাতিভেদ করতে নেই। কথাগুলো মনের গভীরে গেঁথে গিয়েছিলো, যা থেকে এখনো বের হতে পারিনি। বিবেকানন্দের কথায় খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম- "জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।" তাই যখন দেখতাম, আমাদের ঠাকুর ঘরে কোন মুসলমান ঢুকতে পারতো না, তখন মাকে বিবেকানন্দের রেফারেন্স দিতাম। একবার দেখলাম, আমার ঠাকুমা তার নাতির সমান বয়সী ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে পায়ে ধরে নমস্কার করছে। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই জাতিভেদ কেন? মা বললেন, ব্রাহ্মণতো, তাই। অবধারিত প্রত্যুত্তর ছিলো - বইয়ে তো জাতিভেদ করতে নিষেধ করা আছে!
প্রশ্ন কেবল হিন্দু ধর্মেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম ধর্ম চলে আসতো। হযরত ইব্রাহিম যদি দেখতো তার ছেলেই খুন হয়েছে, দুম্বা নয়, তাহলে কি মানুষজন নিজের সন্তানকেই বলি দিতো? আর, পুত্রের বদলে দুম্বা জবাইয়ের এই গল্প কতটুকুই বা বিশ্বাসযোগ্য? ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অর্ধেক উত্তরাধিকার আসলে মেয়েদের কতখানি সমতা দেয়? বেহেশতে হুর-পরীর লোভ কতখানি সভ্যতার পরিচায়ক?
সময়ের সাথে প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আসে। ঈশ্বর/আল্লাহ কি আদৌ আছেন? সন্দেহ দেখা দেয়। সিদ্ধান্তে আসতে পারিনা। তাই সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে বরং নিজে ভাল থাকার ও ভাল কাজ করার মন্ত্রে উদবুদ্ধ হই। প্রশ্নটা মনে রয়েই যায়। নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিজ্ঞান আর যুক্তিবাদিতা দিয়ে উত্তর খুঁজে বেড়াই। একসময় বুঝতে পারি বিবর্তন। বুঝতে পারি বিবর্তন, জীববিজ্ঞান আর জেনেটিক্সের অনিন্দ্য সুন্দর সহাবস্থান; যাদের সাথে ধর্মের অবস্থান সংঘাতময়। চিন্তায় পরিবর্তন আসে। সংশয়বাদিতা ছেড়ে এখন আমি নাস্তিক। নাস্তিকতা আমার কোন ধর্মীয় অবস্থান নয়, বরং আমার বুদ্ধিভিত্তিক অবস্থান।
অদ্ভূত, প্রশ্ন করা আজ আমার দেশে অপরাধ। বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে বুদ্ধিভিত্তিক অবস্থান নেয়া আজ ঘৃণ্যতম কাজ, যার যোগ্যতম পুরস্কার মৃত্যু। কী অদ্ভুত জাতি আমরা। ওয়াশিকুর বাবুর কথা আজ বড় বেশি সত্য -
"মোল্লা স্বাধীন, জঙ্গি স্বাধীন, ছাগু স্বাধীন, মুমিন স্বাধীন, দুর্নীতিবাজ স্বাধীন, রাজনৈতিক নেতা স্বাধীন, পাতি নেতা স্বাধীন, ধর্ষক স্বাধীন, সামরিক বাহিনী স্বাধীন, সুশীল সমাজ স্বাধীন, পিনাকী স্বাধীন, শফি হুজুর স্বাধীন, দলদাস স্বাধীন, গার্মেন্টস মালিক স্বাধীন, লঞ্চ মালিক স্বাধীন...
স্বাধীন নয় কৃষক-শ্রমিক,
স্বাধীন নয় কথিত সংখ্যালঘু-আদিবাসী,
স্বাধীন নয় মুক্তচিন্তার মানুষ,
স্বাধীন নয় মানুষ হতে চাওয়া মানুষগুলো..."
ওয়াশিকুর বাবুর কথা আগে শুনিনি কখনো। অভিজিৎদার সাথে ব্লগে দুয়েকবার কথা হলেও, ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি কখনো। তারপরেও, তাঁরা আমার আত্মার আত্মীয়। আমার বুদ্ধিভিত্তিক পরিবারের সদস্য। রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের জন্যও এমন করে কাঁদিনি কখনো, যতটা কেঁদেছি তাঁদের জন্য। আর কোন মৃত্যু আমার মনোজগত আর জীবনাচরণকে এমন তছনছ করেনি কখনো, যতটা করেছে তাঁদের মৃত্যু।
অভিজিৎদা ও ওয়াশিকুর বাবু, আপনাদের মৃত্যু আপনাদের বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনকে দমাতে পারবে না। আপনাদের আদর্শ আমরা বহন করছি আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে। মৃত্যুহুমকির এত সামর্থ্য কই আমাদের থামানোর! আমরা আছি আপনাদের আদর্শের ধারক হয়ে।
10 comments:
Good information https://www.youtube.com/channel/UCoB4-0nvZest7lQXoh-eFsw
আমাদের দেশে অনেক প্রতিভাবান সিঙ্গার আচে কিন্ত তাদের না নিয়া শুধু কপি পেস্ট করা হয় | আজ তা নিয়া
খেলা হবে| বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন Bangla Copied Songs
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাল পোস্ট দেয়ার জন্য
http://itblogs-bd.com
http://tanvirhossain.com.bd/
This is very nice post. Thanks for sharing with us.
Love
You may also visit my blog and leave your sweet comment.
Onlin Study Care 24
ENGLISH FOR TODAY | Class Eight
ENGLISH FOR TODAY | Classes Nine-Ten
ENGLISH FOR TODAY | Classes Eleven-Twelve
ভাই আপনি একথার প্রমাণ দিতে পারবেন যে - কলি যুগের ২৫% মানুষ সত্য কথা কয়? আমিতো দেখি এ যুগের ১০০% মানুষ মিথ্যা কথা কয়, সুদ খায় আরো কতকি! কৃষ্ণকাল
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে এই পোস্টের জন্য। যে প্রশ্নগুলো আপনি করেছিলেন প্রশ্নগুলো আসলে অনেকের মনেই জাগে। কিন্তু তা প্রকাশ করার মতো সাহস এবং জানার ইচ্ছা হয়তো সবার মধ্যে থাকে না।
বাস্তবতা নিয়ে ব্লগ পড়তে আমার সাইটটি ভিজিট করতে পারেন।
ভিজিট করুন
পরিবার বলতে এমন একদল লোককে বোঝায় যারা রক্ত, বিবাহ বা দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে সম্পর্কিত এবং যারা একক হিসাবে একসাথে থাকে।
https://shoppix.sellbd.shop/?fbclid=IwY2xjawEn4-pleHRuA2FlbQIxMAABHa48IauXiymLusf1D6G2z36j2IMyK9zfzTGECOT8C5hYAUYGqNEsKIdQEQ_aem_g-TjF3rfvANX4-7vviuzcw
Post a Comment