Friday, February 26, 2010

এসো, গণিত শিখি

১.
মেজাজটাই চড়ে গেল পল্লবের। কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের মুখে এমন কথা শুনলে মেজাজের আর দোষ কি? বলে কি না- "দুয়েকটা কঠিক অংক মুখস্থ করলে কিচ্ছু হয় না"। পল্লবকে দেখে কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না যে সে এত ক্ষেপে আছে। সে নড়েচড়ে ঘাড় সোজা করে সোফায় হালকা হেলান দিয়ে বসে। হাত দুটো একসাথে মুঠো করে শক্ত করে ধরে রাখে। পল্লবের ভিতরে যত রাগ তার সবটুকু উত্তাপ বয়ে যায় দুই হাতের ঐ শক্ত মুঠোর উপর দিয়ে। মুহুর্তের জন্য চুপ থেকে, গলার স্বর স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নামিয়ে, অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ ভাষায় ধীর লয়ে বলতে থাকে - "মুখস্থ করলে তোমার ছেলে নম্বর ঠিকই পাবে, কিন্তু অংক শিখবে না কোনদিন।"

বুয়েটে পড়া পল্লবের এমন গুরুগম্ভীর কথা ফেলে দিতে পারে না তার মেসো (খালু) সহকারী অধ্যাপক অনীল দত্ত। চুপ থেকে পল্লবকে তার কথা শেষ করতে দেয়- "অংক মুখস্থ করে তোমার ছেলে ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত হয়তো হাইয়েস্ট নম্বরও পাবে, তবে এরপর আর না। আমি এ কথা খাতা-কলমে লিখে দিতে পারি।"

আস্তে আস্তে গলা উঁচুতে উঠতে থাকে পল্লবের, ভাষার শুদ্ধতাও কমতে থাকে। তর্জনী উঁচিয়ে ক্লাশ ফোরে পড়া পলককে উদ্দেশ্য করে বলে- "শোন্‌, তোর বাপে যতই অংক মুখস্থ করতে কউক, তুই জীবনে অংক মুখস্থ করবি না। নাম্বার কম পাইলে পা, তাও মুখস্থ করবি না। নাম্বার দিয়ে গাডা খাবি নাকি?"

পলুদাকে দারুণ পছন্দ পলকের। মায়ের কাছে পলুদার গল্প শুনতে শুনতে তাকেই পড়ালেখার আদর্শ ধরে নিয়েছে মনে মনে। তাই রাগী আর বদমেজাজী বাবার কথাকেও এখন সে পাত্তা দেয় না। পলুদার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে-"আইচ্ছা"।

ঘটনা হয়েছে- ২য় সাময়িক পরীক্ষায় পলক অংকে ৮০ এর মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৫২। ক্লাস টেস্টের বাকি ২০ এর মধ্যে পেয়েছিল ১৫। ক্লাসে তাই তার অবস্থান এখন ৩ থেকে ৮ এ চলে গেছে। অনীল দত্তের বিশেষ উৎকন্ঠা সে কারণেই।  ছুটিতে বেড়াতে এলে তাই পল্লবকে ডেকে মাসি বীণা দত্ত চুপি চুপি বলেন- "ভাইডারে ইট্টু বুঝাইয়া দে না, বাবা। কেমনে পড়তে অইব দেহাইয়া দিয়া যা। ইট্টুও পড়ে না রে...। তুই কইয়া দিয়া যা, তর কথা শুনব।"

পল্লব চুপ করে শোনে। সে জানে পলক তাকে ভীষণ পছন্দ করে। সে নিজেও একটু বেশিই আদর করে এই ভাইটাকে, একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয়।

২.
বিকেলে পলককে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে পল্লব। মূল উদ্দেশ্য পলককে কিছুটা জ্ঞান দেয়া। কিন্তু খালি খালি উপদেশ সে শুনবে কেন? তাই পল্লব ঠিক করেছে আগে তাকে খাওয়াবে, তার সাথে গল্প করবে, তারপর কোন এক কথার সূত্র ধরে পড়ালেখার কথা নিয়ে আসবে। বাজারের কাছাকাছি আসতেই পল্লব বলে- "আজকা তোরে খাওয়ামু। কী খাবি ক।"

পলক বলার মত বিশেষ কথা খুঁজে পায়- "জান পলুদা... আঙ্গ লগের বাইত বিশুদা আছে না... হেয় না বাজারঅ দোহান দিছে।" [জান পলুদা, আমাদের বাড়ির পাশে যে বিশুদা আছে সে বাজারে দোকান দিয়েছে।] "পুরি-সিংগারার দোহান, যদি খাইতা... ক-ঠি-ন টেস্ট"।

পল্লব মুচকি মচকি হাসে- পিচ্চিটা এরই মধ্যে তার কাছ থেকে 'কঠিন' শব্দটা শিখে নিয়েছে। বলে- "চল্‌ তাইলে বিশুর দোহানেই"।

দুই ভাই মিলে বিশুর দোকানে যায়। পল্লবকে দেখে বিশু বিশেষ খাতির করে খাওয়ায়। সত্যিই বেশ মজাদার খাবার, বিশেষ করে আলুর চপটা- ভিতরে খানিকটা মুরগির মাংস দেয়া। মাংসের ঝোল দিয়ে খেতে আসলেই ক-ঠি-ন টেস্ট!

খেয়ে দেয়ে রেললাইনের দিকে হাঁটতে থাকে দুজনে। নীরবতা ভাঙ্গে পলকের আগ্রহে - "আইচ্ছা পলুদা, তুমি বলে ছুডবেলায় বান্দর আছিলা?"

পল্লব বুঝতে পারে- বীণা মাসি তার গল্প বেশ ভালভাবেই করেছে। হাসতে হাসতে বলে- "হ, আছিলাম তো, তোরে কইল কেডা?"

উত্তর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না পলক। আবার জিজ্ঞেস করে- "তুমি বলে বান্দরামি কইরাও ঠিকমত পড়াশুনা করতা?"

"আমি পড়াশুনা করতাম কম, তয় যতটুকু পড়তাম মন দিয়া পড়তাম, বুইঝা পড়তাম, আর নিয়মিত পড়তাম।" আসল উদ্দেশ্য কিছুটা সফল করতে পেরে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পল্লব।

পলকের কৌতুহল বাড়ে - "এত কম পইড়াও অংকে এত ভালা করতা কেমনে?"

এবার পল্লব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে থাকে- "অংক হইল একটা সোজা জিনিস। এইটা মুখস্থ করতে যাবি- মনে হইব বি-শা-ল কঠিন জিনিস। কিন্তু বুইঝা করবি- দেখবি কত্ত সোজা।" পল্লব খেয়াল করে পলক ঠিক বিশ্বাস করছে না কথাগুলো, কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তাকে তার আশেপাশের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে।

-ধর, তুই এক ধরনের অংক শিখলি আজকা। এহন তুই আশেপাশে খুঁজবি- এই অংকটা কামে লাগে কই? তুই যোগ অংক পারস না?
- হ, পারি।
- আইচ্ছা ক তো বিশুর দোহান দিতে কত টেয়া (টাকা) লাগছে?
- আমি কেমনে কমু? জিগাইছি নি কোনদিন?
- ল (চল), আমরা আন্দাজ করি। ধর- টেবিল গুলার দাম ১০ হাজার টেয়া, চেয়ার গুলা ৫ হাজার। দুইডা মিল্লা কত অইল?
- ১৫ হাজার।
- আর মনে কর চুলাডার দাম ৩ হাজার। পেলেট-টেলেট আরো ৩ হাজার। কড়াইডা দেড় হাজার।

ইচ্ছে করেই পল্লব হিসাবের মধ্যে 'দেড়' ঢুকিয়ে দেয়। পলক হিসাব কষতে থাকে - "পনের আর তিন মিল্লা আঠার। আঠার আর তিনে একুশ। একুশ আর দেড়... বাইশ... সাড়ে বাইশ।"

হিসাবের স্বচ্ছতা দেখে পল্লব খুশি হয়। বুঝতে পারে- এই পিচ্চির বেসিক ভালই। এবার গুণ অংক ধরিয়ে দেয়-

- সাথে ধর ঘর ভাড়া প্রত্যেক মাসে ২ হাজার কইরা ৬ মাসের অগ্রিম। ৬ মাসের ভাড়া কত হয় রে?

ফিসফিস করে গুণের নামতে পড়তে থাকে পলক- "দুই একে দুই, দুই দুগুনে চাইর, তিন দুগুনে ছয়, চাইর দুগুনে আট, পাচ দুগুনে দশ, ছয় দুগুনে বার... বার হাজার!"

- মোট কত হইল?

এবার একটু ঝামেলায় পড়ে বেচারা, আমতা আমতা করতে থাকে। সহজ করে দেয় পল্লব- "আগে সাড়ে ২২ আছিল না? অইডার অর্ধেক হাতে রাইখা দে। বাকি ২২ এর লগে এই ১২ যোগ কর। কত হয়?"

আঙ্গুলে গুণতে থাকে ক্ষুদে গণিতবিদ।

- বাইশ আর বার। তেইশ, চব্বিশ, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪... চৌত্রিশ।
- এইবার হাতের অর্ধেক যোগ কর।
- সাড়ে চৌত্রিশ।
- তাইলে নতুন দোহান দিতে বিশুর কয় টেয়া লাগছে?
- সাড়ে চৌত্রিশ হাজার!
- এইতো হইছে! সাব্বাস! যাহ্‌! তোরে একটা মিমি চকলেট দিমুনে।

পল্লব জ্ঞান দিয়ে যেতে থাকে- "ইমুন কইরা তোর আশেপাশের জিনিস দেইখা তুই নিজে নিজেই অংক বানাবি, নিজেই করবি। তাইলেই দেখবি অংক তোর কাছে সহজ হইয়া যাইব।"

পল্লবের কথায় বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে পলকের।

৩.
পলক আজকে অন্যরকম খুশি। ঢাকায় এসেছে আজ। ঢাকায় আসার মূল কারণ যদিও কাকাত বোনের বিয়ে, পলকের খুশি হওয়ার মূল কারণ অবশ্য তা নয়- বরং পলুদার সাথে শিশুপার্ক আর জাদুঘর দেখাই বেশি মজার মনে হয় তার। দুইদিন আগে থেকেই সে বারবার ফোন করে পল্লবকে মনে করিয়ে দিয়েছে- আজ সকালে যেন একটুও দেরি না হয়, পারলে ভোরেই যেন তাকে কাকার বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। বেশ উত্তেজনা হচ্ছে পলকের। বুয়েট দেখা হবে আজ। গোপনে গোপনে সে একটা স্বপ্ন লালন করে- "পলুদার মত আমিও একদিন বুয়েটে পড়ব"।

বুয়েটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল ১০ টা বেজে ১০। নজরুল ইসলাম হলের ৩২৩ নম্বর রুম। রুমে ঢুকেই বিস্মিত হওয়ার পালা- এত বেলা হল, অথচ এখনো ঘুমোচ্ছে একজন! উফ্‌ , এত নোংরা হতে পারে একটা রুম? সমস্ত রুম জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো বই - গল্পের বই-ই বেশি। তিন-তিনটে কম্পিউটারের তারগুলো প্যাঁচ খেয়ে আছে ভীষণ, জীবনেও খুলবে কিনা সন্দেহ। মাকড়শার ঝুল জমে আছে দেয়ালের কোনায় কোনায়। মেঝে দেখলে মনে হয় তা মুছা হয়নি কোনদিন। অন্য সব বুয়েট-মুগ্ধ মানুষের মতো পলকও এই অগোছালো ভাবের পিছনে একটা কারণ খুঁজে পায়- বুয়েটের ছাত্ররা অনেক পড়াশুনা করে তো, ঘর গোছানোর এত সময় কোথায় তাদের!

সকালটা কাটল কম্পিউটার নিয়ে। আগেও কম্পিউটার ব্যবহার করেছে পলক, তবে এতটা সময় জুড়ে এই প্রথম। গেম্‌স্‌ আর খেলোয়াড়ের ছবির দিকেই আগ্রহ বেশি। বিশেষ করে শচীন আর সাকিবের ছবি যতই দেখে আশা মেটে না। পল্লব ইন্টারনেট থেকে ছবি ডাউনলোড করে দেখায়। কিন্তু এত সময় লাগে যে সে জিজ্ঞেস কর- "ছবিগুলা আছে কৈ? তুমি নিজে গিয়া নিয়া আইতে পার না?"।

ছোট্ট এই ছেলের কৌতুহলী প্রশ্নে থতমত খায় পল্লব। কী বলবে ভাবতে সময় নেয় কিছুটা- "এই ছবিগুলা আসতাছে বিদেশ-তে- কোনটা ইন্ডিয়ারতে, আবার কোনটা এমেরিকারতে। ছবিগুলা আসতে সময়তো একটু লাগবোই"।
- আর এই কম্পিউটার?
- কম্পিউটারের বিভিন্ন পার্টস বিভিন্ন দেশ থেইকা আসে। চীন, মালয়েশিয়া, আমেরিকা এইসব দেশ থেইকা।
- আইচ্ছা, অইসব দেশে কি A, B, C, D উল্ডাপাল্ডা? আঙ্গ (আমাদের) মত না?

ভুরু কুচকায় পল্লব। এই পিচ্চি বলে কী! তবে উত্তর দিয়ে যায়- "উল্ডাপাল্ডা হইব কেন? আম্‌গ মতই।"
- তাইলে কীবোর্ডে উল্ডাপাল্ডা A, B, C, D কে? ঠিক কইরা বসাইতে পারে না?

হা হা হো হো করে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নেয় পল্লব। এই তাহলে কাহিনী! হাসির দমক থামিয়ে অভিনব প্রশ্নকর্তাকে সহজভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে - "A,B,C,D গুলার মধ্যে কিছু কিছু অক্ষর বেশি কামে লাগে, আর কিছু কিছু কম। যেমন- A,S এইগুলা বেশি বেশি কামে লাগে, আর Q,W,X এইগুলা কম কামে লাগে।  তো, টাইপ করার সময় বেশি কামের অক্ষরগুলা যাতে আঙ্গুলের কাছে কাছে থাকে, অইরম কইরা সাজাইতে গিয়া A,B,C,D গুলা উল্ডাপাল্ডা হইয়া গেছেগা।" কীবোর্ডে আঙ্গুল রেখে বুঝিয়ে দেয় পল্লব। তখন ছুটে আসে অন্য প্রশ্ন- "তোমার কম্পিউটারেতো খালি ইংলিশ অক্ষর, বাংলা নাই?"

এইবার বেশ আগ্রহের সাথে পল্লব উত্তর দেয়- "হ্যাঁ, আছে!" বলেই একটা ব্লগ সাইট, আর দুইটা বাংলা পত্রিকার সাইট খুলে দেখায়। খুশি হয়ে যায় পলক- "আরে! কম্পিউটারের ভিতরে পত্রিকা। কী মজা! আমি পত্রিকা পড়মু।"

বাঁধা দেয় পল্লব- "এখন না, আগে চল খাইতে যাই। এরপর জাদুঘর আর শিশুপার্ক। এখন না বাইর হইলে দেরি হইয়া যাইব।"

মেনে নেয় পলক- "আইচ্ছা, ঠিক আছে, আইয়া দেখমু নে।"


৪.
দুপুরে কেন্টিন বন্ধ, খাওয়ার জন্য ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে হবে। হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিয়েই তাজ্জব বনে গেল পলক- গাড়ির ভিতরে বই! পল্লবকে জিজ্ঞেস করে- "ঐ গাড়িটার ভিতরে এত বই কেন্‌? বাড়ি বদলায় নাকি? হেই বাড়ির লোকজন মনে হয় বেশি পন্ডিত।"

বক্রোক্তিটা নজর কাড়ল পল্লবের। সে হাসল, কিন্তু কিছু বলল না, বরং গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। পলক খেয়াল করল- গাড়ির সামনের কাচে লেখা "আলোকিত মানুষ চাই"। পলুদার কাছ থেকে জেনে নিল- এটা একটা লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি-গাড়িটা প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বুয়েটের স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে আসে। এখানের ছেলে-মেয়েরা যারা এই গাড়ির সদস্য, তারা এক সপ্তাহের জন্য দুইটা করে বই নিতে পারে। বইগুলো পড়া শেষ হয়ে গেলে পরের সপ্তাহে আবার দুইটা বই। এভাবেই চলে।

পলক গাড়ির ভিতর ঢুকে নন্টে-ফন্টের বই খুঁজল, কিন্তু বিধি বাম, পেল না। গাড়ি থেকে বের হয়েই তাই সে বলে- "আমি বড় হইয়া যখন একটা লাইব্রেরি দিমু, তখন অইখানে নন্টে-ফন্টের বই রাখমু।"

তারপর কী যেন ভাবে- "আইচ্ছা পলুদা, আঙ্গ বাড়ির দিগে ইমুন লাইব্রেরি অইতে পারে না?"

উত্তরের আশা করে না সে। বরং চিন্তিত হয়ে পড়ে- "বহুত টাকা লাগবো, না?"
- "হুম, টাকাতো লাগবেই।" দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পল্লব।
- আইয়ো, অংক কইরা বাইর করি কত টাকা লাগবো। কওছে গাড়ির মইধ্যে বই আছে কয়ডা?- পলকের অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন।
- কয়েক হাজার।
- ধরলাম ৩ হাজার। একেকটার দাম কত কইরা?
- ১০০ কইরা ধর।
- তিনশ হাজার... তিন লাখ।
- আর গাড়ির দাম কত?
- খাইছে, তুই গাড়ি কিনবি নাকি??
- আরে, কও না!
- বাসের দাম তো ঠিক জানি না, হইব ১৫-২০ লাখ।
- যাও, ধরলাম ২০ লাখ। ২০ আর ৩ মিল্লা ২৩।
- আর খরচ কী আছে?
- ড্রাইভারের খরচ, তেল খরচ, লাইব্রেরি কার্ডের খরচ।
- এইতান সব কিছু ২ লাখের মইধ্যে অইত না?
- হইয়া আরো বেশি হইব।
- তাইলে ২৫ লাখ টেয়া অইলে ইমুন একটা গাড়ি-লাইব্রেরি দেওন যাইব।

আফসোস পলকের - ইস্‌ কেউঐ যদি টেয়াডা দিয়া দিত!


৫.
ডাইনোসরটা ছাড়া জাদুঘরের আর কিছু ভাল লাগেনি পলকের। শিশুপার্কটাই বেশি ভাল। রেলগাড়িতে চড়েছে তিন বার। চড়কি যখন এক্কেবারে উঁচুতে, ভালই ভয় পেয়েছে তখন; কথাবার্তা না বলে চুপ করে শক্ত হয়ে বসে ছিল। বসে বসে ঘুরায় যেটা, নাম যেন কী রাইডটার, ঐটাও বেশ ভাল লেগেছে। বিমান, ঘোড়ার গাড়ি, নাগরদোলা সবই ভাল লেগেছে কম-বেশি। পার্ক থেকে বের হয়ে চটপটি আর আইসক্রীম খেয়ে সন্ধ্যার আগেই আবার হলে ফিরে এসেছে। এসেই দাবি- "পেপার আইনা দেও, পেপার পড়মু।"

কম্পিউটারের ভিতর পেপার, মজাই আলাদা। পল্লব পলককে পেপার পড়তে দিয়ে হাতমুখ ধুতে যায়। হাতমুখ ধুয়ে যখন রুমে ফিরে তখন পলক বলে- "পলুদা, অন্যদিনতো তুমি আমারে অংক দেও। আজকা আমি তোমারে একটা অংক দেই। বিশুদার দোহান দিতে খরচ হয় সাড়ে চৌত্রিশ হাজার টাকা। একটা গাড়ি-লাইব্রেরি দিতে লাগে ২৫ লাখ টাকা। আর বিমানবন্দরের নাম পাল্ডাইতে খরচ অয় ১২০০ কোটি টাকা। তাইলে কও তো- বিমানবন্দরের নাম পাল্ডানের টেয়া দিয়া কয়ডা বিশুদার দোহান দিওন যাইবো? কয়ডা গাড়ি-লাইব্রেরি দেওন যাইবো?"

পল্লবের অংক মিলে না।

Monday, February 22, 2010

কবে যে পুরুষগুলো মানুষ হবে

"ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া, বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে..." - ৬ নম্বর বাসে "তিল ঠাঁই আর নাহিরে"- পরিমাণ ভিড়ের মধ্যে এমন কর্কশ আওয়াজের মধুর সংগীত আপনার নজর কাড়বেই। আমারও কেড়েছে। উৎসের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতে পারি নকিয়া-১১০০ গোত্রের মুঠোফোন নিঃসৃত এ ধ্বনি।

- হ্যালো, স্লামালিকুম।

মিহি সুর শুনে আন্দাজ করা যায় - উনি তরুণী না হলেও মধ্যবয়স্ক হবেন না। একই সুরে আবার -

- ওয়ালাইকুম সালাম।

সম্ভবতঃ ওপাশ থেকেও আবার স্লামালিকুম দেয়া হয়েছে। চিকন সুরের বিরক্তি ভরা কন্ঠ সঙ্গী করে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে বাস।

- আপনি কে বলছেন সেটা বলেন আগে।
- জায়গা দিয়ে কি করবেন? কাকে চাচ্ছেন বলেন।
- এটা ঢাকা।
- ঢাকার কোন্‌ জায়গা তা জানার দরকার নেই। কাকে চাচ্ছেন বলেন।
- আরে ভাই আপনি কে?
- কি নাম? আবার বলেন।
- না, আপনাকে চিনতে পারলাম না।
- না, এই নামে কেউ থাকে না এখানে।
- বললাম তো এই নামে কেউ থাকে না এখানে।
- আমার নাম জেনে আপনার কি?
- আবার জায়গা... জায়গা দিয়ে কি করবেন? এটা ঢাকা।
- আপনি রং নাম্বারে ফোন করেছেন।
- আমার নাম্বার আপনার ডায়াল লিস্টে আছে।
- আমার কন্ঠ সুন্দর তাতে কি?

এই কর্মক্লান্ত বিকেলে ভদ্রমহিলার মনোজগতের কথা কল্পনা করতে মনোবিজ্ঞানী হতে হয় না।

এদিকে বাসটা সামনে এগোতে জোর চেষ্টা করছে। যথারীতি স্বাভাবিক ফলশ্রুতি- অতীব জোরের ব্রেক... আরো স্বাভাবিক পরিণাম- কিছু যাত্রীর সামনের দিকে হেলে গিয়ে পড়ি-মরি অবস্থা। এরই মাঝে আবার আমাদের নজর চলে যায় কর্কশ আওয়াজের মধুর সংগীতের দিকে - "ওরে নীল দরিয়া..."

Saturday, February 20, 2010

এমনই হয়...

আমাদের ঘরের পাশেই 'মিষ্টি' আম গাছটা ছিল। পাশে না, পাশে না। ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতরই তো! না হলে বারান্দাটা ঐ কোণে এসে বেঁকে গেল কেন? আমাদের বারান্দাটা গাছটাকে একদম দেখতে পারত না, আর আমাদের সবার প্রতি ভীষণ ক্ষোভ তার। গাছটার প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বের কারণে বাড়ির ডিজাইনের মাঝে গাছটা এসে পড়লেও তা আর কাটা হয়নি, বরং ছেঁটে দেয়া হয়েছে হতভাগা বারান্দাকে। আর আমরা গাছটার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হবোই না কেন? যা মিষ্টি ছিল আমগুলো! আহা, এখনো জিবে স্বাদ পাই! সে কারণেই তো তার নাম আমরা দিয়েছিলাম - 'মিষ্টি'।

আমাদের বাড়িতে যে পাঁচটা আম গাছ ছিল প্রত্যেকেরই একটা করে নাম ছিল - মিষ্টি, সিঁদুরে, চ্যাপ্টা, টুইরা আর জর্ণা। সিঁদুরে গাছের আম একটু বড় হলেই সিঁদুরে লাল রংয়ের হত। কী সুন্দর যে রং! কী আর বলব। আমি ঐ গাছের আম না খেয়ে রেখে দিতাম। আগে বন্ধুদের দেখাতাম, পরে খেতাম। চ্যাপ্টা গাছটা ভীষণ লম্বা হলেও আমগুলো ছিল চ্যাপ্টা। আঁটিও ছিল ছোট। আর স্বাদের দিক দিয়ে মিষ্টির পরেই সে। তবে ফলন অন্যদের চেয়ে বেশি হওয়ায় চ্যাপ্টাই ছিল আমাদের আমক্ষুধা মেটানোর প্রধান অবলম্বন। টুইরা গাছটা ছিল ছোটখাট গড়নের। কাচা থাকে অবস্থায় অসম্ভব টক থাকত আমগুলো। কিন্তু পাকলে সেগুলোই কেমনে করে যেন মিষ্টি হয়ে যেত! তখন পোকার জ্বালায় আম খেতে বড়ই কষ্ট লাগত। জর্ণা গাছটার আমগুলো দেখতে সুন্দর। হলদে রং-এর উপর ছোপছোপ লাল ফোঁটার আমগুলোতে এক ধরনের গন্ধ থাকত। ঐ গন্ধকে নাকি 'জর্ণা' গন্ধ বলে। আমি আজ পর্যন্ত এই আম গাছ ছাড়া আর কোথাও 'জর্ণা' শব্দটার প্রয়োগ দেখিনি, এমনকি জানিওনা আসলেই শব্দটা প্রমিত বাংলা ভাষায় আছে কি না। জর্ণা গন্ধের কারণেই বাড়িতে অন্য কোন আম থাকলে জর্ণার দিকে আমরা হাত দিতাম না একেবারেই।

সম্ভবত ১৯৯১ সালের কথা। প্রচন্ড ঝড়ে 'মিষ্টি' আম গাছের একটা বড় অংশ ভেঙ্গে পড়ল আমাদের ঘরের চালে। যা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন! ভেবেছিলাম ঘরটা বুঝি ভেঙ্গেই গেল। না ঘর ভাঙ্গেনি, তবে চালের টিন একেবারে বসে গিয়েছিল। মিস্ত্রি ডেকে চাল ঠিক করাতে হয়েছিল। একেতো ঝড়ে আমগাছটা ছোট হয়ে গেছে, আবার একই সাথে আমাদের ঘরের জন্য সেটা হুমকিস্বরূপ - এই দুই কারণে আমাদের পক্ষপাতিত্বও গাছটাকে কেটে ফেলা থেকে রক্ষা করতে পারল না। গাছের মৃত্যুতে বারান্দাও কষ্ট পেয়েছিল ভীষণ। 'মিষ্টি'-র অনুপস্থিতি বারান্দার অপূর্ণতাটুকুকে তুলে ধরল নগ্নভাবে।

সিঁদুরে আর টুইরা দুটোই মরেছিল বয়সের কারণে। আর চ্যাপ্টা, মিষ্টির মৃত্যুর পর যে ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু, তার মৃত্যু ছিল সবচেয়ে করুণ। আমাদের বাড়ির সামনের খালি জমিটা দিয়ে আমরা মূল রাস্তায় উঠতাম। সেটি যখন বিক্রি হয়ে গেল, তখন নতুন মালিক সে জমির চারপাশে দেয়াল দিতে চাইলে রাস্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল চরমভাবে। আর রাস্তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে আত্মত্যাগ করতে হল চ্যাপ্টাকেই। চ্যাপ্টার এক সন্তান এখন আমাদের বাড়িতে আছে। মায়ের গুণটুকু পনের আনাই ধরে রেখেছে; তবে আকারে লম্বা নয় মোটেও, ছোটখাট।

আর জর্ণা গাছটা, যে গাছটার আম আমরা পারতপক্ষে খেতে চাইতাম না, সেটা টিকে আছে এখনও। টিকে আছে সদম্ভে।

এমনই হয়। ছাত্ররাজনীতির যে অংশ নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল তার মৃত্যু হয়েছে অনেকদিন আগেই। আর সদর্পে টিকে আছে লেজুরবৃত্তিকারী অংশটুকু! আর বকররা প্রাণ হারায় অকালে...